সমবায় সমিতি কী? গঠন করার A-Z গাইড (২০২৫) What is a Cooperative Society? A-Z Guide to Forming One (2025)

সমবায় সমিতি কী? গঠন করার A-Z গাইড (২০২৫) What is a Cooperative Society? A-Z Guide to Forming One (2025)

Table of Contents

সমবায় সমিতি “একতাই বল”, সম্মিলিত সাফল্যের পূর্ণাঙ্গ গাইড (২০২৫) Cooperative Society “Ektai Ball”, Complete Guide to Collective Success (2025)

রহিম চাচা বাংলাদেশের উত্তরের এক গ্রামের প্রান্তিক কৃষক। সারা বছর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তিনি তার জমিতে পাট চাষ করেন। কিন্তু ফসল তোলার পর তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। কারণ, গ্রামের প্রভাবশালী ফড়িয়া বা মধ্যস্বত্বভোগীরা সিন্ডিকেট করে পাটের দাম এমনভাবে কমিয়ে দেয় যে, তার উৎপাদন খরচই উঠতে চায় না। একা প্রতিবাদ করার সাহস বা শক্তি তার নেই। বাজারের এই অদৃশ্য শোষণের কাছে রহিম চাচার মতো গ্রামের শত শত কৃষক প্রতি বছর অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করে।

অন্যদিকে, রাজধানী ঢাকার এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত আবাসিক এলাকায় বাস করেন মিসেস আনোয়ারা। তার মতো আরও অনেক পরিবারেরই হঠাৎ করে অর্থের প্রয়োজন হয়—কখনও সন্তানের স্কুলের বেতন দিতে, কখনও চিকিৎসার জন্য। কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়া বেশ জটিল এবং ক্ষুদ্র ঋণের সুদের হারও অনেক বেশি। এলাকার সুদখোর মহাজনদের কাছ থেকে টাকা নিলে চক্রবৃদ্ধি সুদের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার ভয়।

এই দুটি ভিন্ন চিত্র, একটি গ্রামের এবং অন্যটি শহরের, কিন্তু এদের পেছনের সমস্যাটি একই—একক ব্যক্তির দুর্বলতা এবং সংঘবদ্ধ শোষণের শিকার হওয়া। এই সমস্যার সবচেয়ে প্রাচীন, কার্যকর এবং মানবিক সমাধানটির নামই হলো সমবায় সমিতি (Cooperative Society)

সমবায় কোনো নতুন ধারণা নয়। এটি মানুষের একসাথে চলার, একে অপরকে সাহায্য করার এবং সম্মিলিত শক্তি দিয়ে নিজেদের ভাগ্য নিজেদেরই গড়ার এক চিরন্তন দর্শন। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে রহিম চাচারা একত্রিত হয়ে নিজেরাই নিজেদের ফসলের বাজার তৈরি করতে পারেন, আবার মিসেস আনোয়ারারা মিলে নিজেদের সঞ্চয় দিয়ে একটি নির্ভরযোগ্য আর্থিক তহবিল গঠন করতে পারেন।

এই পূর্ণাঙ্গ গাইডটিতে আমরা সমবায় সমিতির একদম গোড়ার কথা থেকে শুরু করে এর গভীরে প্রবেশ করব। এখানে আমরা জানব:

  • সমবায় সমিতি আসলে কী এবং এটি কীভাবে একটি সাধারণ কোম্পানি বা এনজিও থেকে আলাদা?
  • কোনো জাদুমন্ত্রে নয়, বরং কোন ৭টি বিশ্বজনীন নীতির ওপর ভিত্তি করে একটি সফল সমবায় সমিতি দাঁড়িয়ে থাকে?
  • সমবায়ের মূল উদ্দেশ্যগুলো কী এবং এটি কীভাবে সমাজের সাধারণ মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে?
  • বাংলাদেশে কত ধরনের সমবায় সমিতি রয়েছে এবং কীভাবে আইন মেনে একটি সমিতি গঠন করা যায়?

চলুন, সম্মিলিত প্রচেষ্টার এই অসাধারণ শক্তিকে জানি এবং বুঝি, যা সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেয় অসাধারণ ক্ষমতা।


সমবায় সমিতি কী? (What is a Cooperative Society?)

‘সমবায়’ শব্দটি ভাঙলেই এর অর্থ স্পষ্ট হয়ে যায়: ‘সম’ অর্থাৎ সমান এবং ‘বায়’ অর্থাৎ সম্মিলিত প্রচেষ্টা বা কাজ। সুতরাং, সমবায় সমিতি হলো সম-অধিকারের ভিত্তিতে সম্মিলিত প্রচেষ্টার একটি সংগঠন।

সংজ্ঞা ও মূল ধারণা

সহজ ভাষায়, সমবায় সমিতি হলো একই ধরনের आर्थिक, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য সমমনা কিছু মানুষের স্বেচ্ছায় মিলিত একটি স্ব-শাসিত সংগঠন, যা যৌথ মালিকানাধীন এবং গণতান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।

বাংলাদেশে প্রচলিত সমবায় আইন, ২০০১ অনুসারে, সমবায় সমিতি বলতে এই আইনের অধীনে নিবন্ধিত কোনো সমিতিকে বোঝানো হয়েছে।

এই আইনি সংজ্ঞার পেছনের দর্শনটি আরও গভীর। এর মূলমন্ত্র হলো: “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে” এবং এর প্রাতিষ্ঠানিক নীতি হলো “সদস্যদের দ্বারা, সদস্যদের জন্য”। এর মানে হলো, সমিতির মালিক এর সদস্যরাই, সমিতির পরিচালক এর সদস্যরাই এবং সমিতির সকল কার্যক্রমের চূড়ান্ত সুবিধাভোগীও এর সদস্যরাই। এটি বাইরের কোনো سرمایہ دار বা মালিকের মুনাফার জন্য কাজ করে না, বরং এর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো সদস্যদের সেবা প্রদান এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা।

কোম্পানি বা অন্যান্য ব্যবসা থেকে এটি কীভাবে আলাদা? (How is it different from companies or other businesses?

কোম্পানি বা অন্যান্য ব্যবসা থেকে এটি কীভাবে আলাদা?’

অনেকেই সমবায় সমিতিকে একটি সাধারণ ব্যবসা বা কোম্পানির সাথে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু উদ্দেশ্য, গঠন এবং পরিচালনা—প্রতিটি ক্ষেত্রেই এদের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে।

বিষয় যৌথ মূলধনী কোম্পানি (Joint Stock Company) সমবায় সমিতি (Cooperative Society)
১. মূল উদ্দেশ্য শেয়ারহোল্ডারদের জন্য সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। লাভই হলো এর মূল চালিকাশক্তি। সদস্যদের সর্বোচ্চ সেবা প্রদান এবং কল্যাণ নিশ্চিত করা। মুনাফা এখানে গৌণ, সেবাই মুখ্য।
২. নিয়ন্ত্রণ ও গণতন্ত্র নীতি: ‘এক শেয়ার, এক ভোট’ (One Share, One Vote)। যার যত বেশি শেয়ার, তার তত বেশি ভোট এবং ক্ষমতা। একজন ব্যক্তি ৫১% শেয়ারের মালিক হলে, তিনিই কার্যত কোম্পানির একচ্ছত্র অধিপতি। নীতি: ‘এক সদস্য, এক ভোট’ (One Member, One Vote)। একজন সদস্যের ১টি শেয়ার থাকুক বা ১০০টি, তার ভোটের মূল্য ১টিই থাকবে। এখানে পুঁজি নয়, ব্যক্তিই ক্ষমতার উৎস। ফলে کامل গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. মুনাফা বন্টন অর্জিত মুনাফা শেয়ারের অনুপাতে ‘লভ্যাংশ’ (Dividend) হিসেবে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বন্টিত হয়। অর্জিত উদ্বৃত্ত (Surplus) বা মুনাফা সমিতির তহবিলে জমা রাখা হয় এবং একটি অংশ সদস্যদের মাঝে তাদের ‘লেনদেনের অনুপাতে’ (Patronage Refund/Dividend) ফেরত দেওয়া হয়।
৪. মালিকানা শেয়ারহোল্ডাররা মালিক, যারা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের হতে পারেন এবং তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে বিনিয়োগ থেকে লাভ করা। সদস্যরাই মালিক, যারা সাধারণত একই এলাকা বা একই পেশার হন এবং তারা সমিতির সেবা গ্রহণ করার জন্যই সদস্য হন।

বাস্তব উদাহরণ দিয়ে পার্থক্যটি বোঝা যাক:

  • কোম্পানির উদাহরণ: একটি প্রাইভেট ব্যাংক (কোম্পানি) তার গ্রাহকদের ১০% সুদে ঋণ দিয়ে এবং আমানতকারীদের ৪% সুদে আমানত নিয়ে মাঝখানের ৬% মুনাফা অর্জন করে, যা তার শেয়ারহোল্ডারদের পকেটে যায়।
  • সমবায়ের উদাহরণ: একটি ঋণদান সমবায় সমিতি তার সদস্যদের কাছ থেকে ৭% সুদে আমানত সংগ্রহ করে এবং অন্য অভাবী সদস্যদের ৮% সুদে ঋণ দেয়। এখানে মাঝখানের মাত্র ১% উদ্বৃত্ত সমিতির পরিচালনা খরচ এবং ভবিষ্যৎ তহবিলের জন্য ব্যবহৃত হয়। মূল উদ্দেশ্য মুনাফা নয়, সদস্যদের আর্থিক প্রয়োজন মেটানো।

সমবায় সমিতির মূলনীতি ও উদ্দেশ্য (Principles and Objectives)

সমবায় সমিতি কোনো বিচ্ছিন্ন ধারণা নয়। এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত কিছু সুনির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। এই নীতিগুলোই সমবায়কে অন্য যেকোনো সংগঠন থেকে আলাদা করে এবং এর সাফল্য ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ৭টি নীতিমালা (The 7 Cooperative Principles)

আন্তর্জাতিক সমবায় মৈত্রী (International Co-operative Alliance) কর্তৃক নির্ধারিত এই ৭টি নীতি হলো প্রতিটি সমবায় সমিতির সংবিধান।

১. স্বেচ্ছামূলক ও উন্মুক্ত সদস্যপদ (Voluntary and Open Membership): সমবায় সমিতিতে সদস্যপদ গ্রহণ বা বর্জন সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবী। যোগ্যতা পূরণকারী যেকোনো ব্যক্তি ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে এর সদস্য হতে পারবেন। কাউকে সদস্য হতে বাধ্য করা যাবে না বা অন্যায়ভাবে বাদ দেওয়া যাবে না।

২. সদস্য দ্বারা গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ (Democratic Member Control): এটি সমবায়ের আত্মা। ‘এক সদস্য, এক ভোট’ নীতির মাধ্যমে সদস্যরা সক্রিয়ভাবে নীতি নির্ধারণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নেয়। সমিতির পরিচালক বা நிர்வாகிகள் সদস্যদের দ্বারাই নির্বাচিত হন এবং তারা সদস্যদের কাছেই জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন।

৩. সদস্যদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ (Member Economic Participation): সদস্যরাই ন্যায্যতার ভিত্তিতে তাদের সমিতির মূলধনে অংশগ্রহণ করে। অর্জিত উদ্বৃত্তের একটি অংশ সমিতির সাধারণ তহবিল হিসেবে জমা থাকে। বাকি অংশ সদস্যদের মাঝে তাদের লেনদেনের অনুপাতে ফেরত দেওয়া হয়, যা সদস্যদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণকে আরও উৎসাহিত করে।

৪. স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা (Autonomy and Independence): সমবায় সমিতি তার সদস্যদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি স্ব-শাসিত সংগঠন। যদি এটি সরকার বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়, তবে তা অবশ্যই সমিতির গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ এবং স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখেই করতে হবে।

৫. শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং তথ্য (Education, Training, and Information): একটি সফল সমবায় সমিতি তার সদস্যদের, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এবং পরিচালকদের সমবায়ের আদর্শ ও কৌশল সম্পর্কে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করে তোলে। এটি সদস্যদের আর্থিক সাক্ষরতা থেকে শুরু করে আধুনিক কৃষি বা ব্যবসার কৌশল সম্পর্কেও অবহিত করে, যা তাদের ব্যক্তিগত এবং সমিতির সম্মিলিত উন্নয়নে সাহায্য করে।

৬. সমবায় সমিতিসমূহের মধ্যে সহযোগিতা (Cooperation among Cooperatives): সমবায় সমিতিগুলো একে অপরকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে সমবায় আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। উদাহরণ: ধরা যাক, পাবনার কয়েকটি দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি মিলে একটি আঞ্চলিক ফেডারেশন গঠন করলো। এই ফেডারেশনটি সম্মিলিতভাবে একটি আধুনিক দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করলো, যা কোনো একটি সমিতির পক্ষে একা করা সম্ভব ছিল না। এর মাধ্যমে তারা তাদের দুধের জন্য আরও ভালো দাম নিশ্চিত করতে পারলো।

৭. সামাজিক দায়বদ্ধতা (Concern for Community): সমবায় সমিতি শুধুমাত্র তার সদস্যদের কল্যাণ নিয়েই ভাবে না, এটি তার পারিপার্শ্বিক সমাজের টেকসই উন্নয়নের জন্যও কাজ করে। উদাহরণ: একটি আর্থিকভাবে সফল সমবায় সমিতি তার উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে এলাকার রাস্তাঘাট মেরামত, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন, স্কুল প্রতিষ্ঠা বা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করতে পারে।

সমবায় সমিতির প্রধান উদ্দেশ্যগুলো কী কী? (What are the main objectives of a cooperative society?)

এই নীতিগুলোর ওপর ভিত্তি করে সমবায় সমিতি কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে:

  • আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন: সদস্যদের পরনির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করা।
  • মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ দূর করা: ভূমিকার Rahim Chacha-র মতো কৃষকরা যদি একটি ‘কৃষক সমবায় সমিতি’ গঠন করেন, তবে তারা সম্মিলিতভাবে তাদের ফসল সরাসরি শহরের বাজারে বা বড় কোম্পানিতে বিক্রি করতে পারবেন। এতে ফড়িয়ারা তাদের ঠকাতে পারবে না এবং তারা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবেন।
  • সঞ্চয় ও ঋণের সুবিধা প্রদান: ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় একত্রিত করে একটি শক্তিশালী তহবিল গঠন করা এবং সেই তহবিল থেকে সদস্যদের জরুরি প্রয়োজনে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা।
  • জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন: ন্যায্যমূল্যে মানসম্মত পণ্য ও সেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সদস্যদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।
  • কর্মসংস্থান সৃষ্টি: সমিতি নিজে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠায় সেখানে ম্যানেজার, হিসাবরক্ষক ইত্যাদি পদে কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।
  • গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা: একসাথে কাজ করার মাধ্যমে সদস্যদের মধ্যে একতা, সাম্য, সততা এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করা।

সমবায় সমিতির প্রকারভেদ (Types of Cooperative Societies)

সমবায় সমিতির মূল দর্শন এবং নীতিগুলো বোঝার পর, এখন প্রশ্ন আসে—বাস্তব জীবনে এগুলো কীভাবে কাজ করে? সদস্যদের প্রয়োজন এবং উদ্দেশ্য অনুযায়ী সমবায় সমিতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। বাংলাদেশে কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে বেশ কয়েক ধরনের সমবায় সমিতি প্রচলিত রয়েছে। চলুন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকারভেদগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম ভিত্তিক প্রকারভেদ (Types based on purpose and activities)

  • ক্রেতা সমবায় সমিতি (Consumer Cooperative): এই ধরনের সমিতির মূল উদ্দেশ্য হলো মধ্যস্বত্বভোগীদের বাদ দিয়ে সরাসরি উৎপাদক বা পাইকারদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে মানসম্মত পণ্য ক্রয় করে সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। বাস্তব উদাহরণ: ঢাকার একটি বড় অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের বাসিন্দারা দেখলেন যে, স্থানীয় বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে গিয়ে তাদের প্রায়ই বেশি দাম দিতে হচ্ছে এবং পণ্যের মান নিয়েও সংশয় থাকছে। তারা একত্রিত হয়ে “শান্তি নীড় उपभोक्ता সমবায় সমিতি” গঠন করলেন। সমিতির পক্ষ থেকে প্রতি সপ্তাহে সরাসরি কারওয়ান বাজার বা অন্য পাইকারি আড়ত থেকে চাল, ডাল, তেল, চিনি এবং টাটকা সবজি কিনে আনা হয়। এতে প্রতিটি পরিবারের মাসিক খরচ প্রায় ৫০০-৭০০ টাকা কমে গেল এবং তারা ভেজালমুক্ত খাঁটি পণ্য পাওয়ার নিশ্চয়তা পেল।
  • উৎপাদক সমবায় সমিতি (Producer Cooperative): ক্ষুদ্র উৎপাদকরা যখন তাদের উৎপাদিত পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করার জন্য বা উন্নত মানের কাঁচামাল সুলভ মূল্যে কেনার জন্য একত্রিত হন, তখন উৎপাদক সমবায় সমিতি গঠিত হয়। বাস্তব উদাহরণ: টাঙ্গাইলের কিছু তাঁত শিল্পী দেখলেন যে, তারা মহাজনদের কাছ থেকে চড়া দামে সুতা কিনতে এবং কম দামে শাড়ি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা “টাঙ্গাইল জামদানি শিল্পী সমবায় সমিতি” গঠন করলেন। এই সমিতি এখন সম্মিলিতভাবে সরাসরি মিল থেকে উন্নত মানের সুতা কেনে, যা তারা আগের চেয়ে কম দামে পায়। এছাড়া, তারা একটি নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করে শহরের বড় বড় শোরুমে এবং অনলাইনে তাদের শাড়ি বিক্রি করে, যার ফলে তারা আগের চেয়ে প্রায় ৩০-৪০% বেশি দাম পায়।
  • ঋণদান সমবায় সমিতি (Credit Cooperative): এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বহুল প্রচলিত সমবায় সমিতি। এর মূল কাজ হলো সদস্যদের মধ্যে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা এবং সেই সঞ্চিত অর্থ থেকে প্রয়োজনে সদস্যদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা। বাস্তব উদাহরণ: আমাদের গল্পের মিসেস আনোয়ারা এবং তার ৫০ জন প্রতিবেশী মিলে “একতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি” গঠন করলেন। প্রত্যেকে মাসে ৫০০ টাকা করে জমা রাখেন। সমিতির তহবিলে যখন যথেষ্ট টাকা জমা হলো, তখন হঠাৎ করে মিসেস আনোয়ারার সন্তানের চিকিৎসার জন্য ১০,০০০ টাকা প্রয়োজন পড়লো। তিনি কোনো জটিল কাগজপত্র বা জামানত ছাড়াই মাত্র এক দিনের মধ্যে সমিতি থেকে ৭% সুদে ঋণ পেয়ে গেলেন, যা তাকে মহাজনের ২০% সুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল।
  • গৃহায়ন সমবায় সমিতি (Housing Cooperative): নগরায়নের এই যুগে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য নিজের একটি বাড়ি বা ফ্ল্যাটের স্বপ্ন দেখা কঠিন। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেই গৃহায়ন সমবায় সমিতির জন্ম। বাস্তব উদাহরণ: চট্টগ্রামের একদল সরকারি কর্মকর্তা একত্রিত হয়ে একটি গৃহায়ন সমবায় সমিতি গঠন করলেন। তারা কয়েক বছর ধরে নিজেদের বেতনের একটি অংশ সমিতিতে জমা রাখলেন। পর্যাপ্ত অর্থ জমা হওয়ার পর, সমিতিটি শহরের উপকণ্ঠে একটি বড় জমি কিনলো। এরপর তারা সম্মিলিতভাবে একজন ডেভেলপারকে দিয়ে সেখানে একটি বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণ করালো। এর ফলে, প্রত্যেকে বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম খরচে নিজ নিজ ফ্ল্যাটের মালিকানা লাভ করলেন।
  • বহুমুখী সমবায় সমিতি (Multipurpose Cooperative): যখন একটি সমবায় সমিতি তার সদস্যদের বহুমুখী প্রয়োজন মেটানোর জন্য একাধিক ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে, তখন তাকে বহুমুখী সমবায় সমিতি বলে। বাস্তব উদাহরণ: আমাদের গল্পের কৃষক রহিম চাচা এবং তার গ্রামের কৃষকরা প্রথমে শুধু তাদের ফসল বিক্রির জন্য একটি উৎপাদক সমিতি (“আদর্শ কৃষক সমবায় সমিতি”) গঠন করেছিলেন। পরে তারা দেখলেন, তাদের ঋণেরও প্রয়োজন, আবার উন্নত সার ও বীজেরও প্রয়োজন। তখন তাদের সমিতিই সদস্যদের জন্য একটি সঞ্চয় ও ঋণদান কার্যক্রম চালু করলো এবং পাশাপাশি একটি দোকান খুলে ন্যায্যমূল্যে সার, বীজ ও কীটনাশক বিক্রির ব্যবস্থা করলো। এভাবে তাদের সমিতিটি একটি বহুমুখী সমবায় সমিতিতে রূপান্তরিত হলো।
  • শ্রমজীবী সমবায় সমিতি (Labour Cooperative): বিভিন্ন পেশার শ্রমিকরা (যেমন: ইলেকট্রিশিয়ান, রাজমিস্ত্রি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী) ঠিকাদার বা মালিকের অধীনে না থেকে নিজেরাই কাজ সংগ্রহ ও সম্পাদনের জন্য এই সমিতি গঠন করেন। উদাহরণ: একটি শহরের ২৫ জন প্রশিক্ষিত ইলেকট্রিশিয়ান মিলে একটি শ্রমজীবী সমবায় সমিতি গঠন করলেন। তারা এখন নিজেরাই বিভিন্ন নির্মাণাধীন ভবনের বৈদ্যুতিক কাজের জন্য টেন্ডারে অংশ নেন। কাজ পাওয়ার পর তারা নিজেরাই তা সম্পন্ন করেন এবং প্রাপ্ত অর্থ থেকে সমিতির খরচ বাদে বাকিটা সমানভাবে ভাগ করে নেন। এতে তারা ঠিকাদারের অধীনে কাজ করার চেয়ে অনেক বেশি আয় করতে সক্ষম হন।

সমবায় সমিতির সুবিধা ও অসুবিধা (Advantages and Disadvantages)

যেকোনো ব্যবস্থারই ভালো এবং মন্দ দুটি দিক থাকে। সমবায় সমিতিও এর ব্যতিক্রম নয়। এর পথে নামার আগে সুবিধাগুলোর পাশাপাশি অসুবিধাগুলো সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।

সুবিধাসমূহ (The Advantages)

  • গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা: ‘এক সদস্য, এক ভোট’ নীতিটি এখানে শুধু একটি স্লোগান নয়, এটি সমবায়ের মূল শক্তি। এর ফলে, একজন দরিদ্র সদস্যের মতামতও ঠিক ততটাই গুরুত্ব পায়, যতটা একজন ধনী সদস্যের। এই গণতান্ত্রিক চর্চা সদস্যদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদাবোধ তৈরি করে।
  • সদস্যদের অর্থনৈতিক কল্যাণ: যেহেতু সমিতির মূল উদ্দেশ্যই হলো সদস্যদের সেবা করা, তাই এর সকল কার্যক্রম তাদের অর্থনৈতিক কল্যাণকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ থেকে মুক্তি এবং সম্মিলিত ক্রয়ের মাধ্যমে খরচ কমানোর ফলে সদস্যদের আয় বাড়ে এবং সঞ্চয় বৃদ্ধি পায়।
  • সহজ গঠন প্রণালী: একটি লিমিটেড কোম্পানি গঠনের আইনি প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। তার তুলনায়, সমবায় আইন ও বিধিমালা অনুসরণ করে একটি সমবায় সমিতি গঠন করা বেশ সহজ।
  • সরকারি সহায়তা ও কর ছাড়: সমবায় আন্দোলনকে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একারণে, সরকার প্রায়ই সমবায় সমিতিগুলোকে প্রশিক্ষণ, ভর্তুকি, সহজ শর্তে ঋণ এবং আয়করের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় প্রদান করে থাকে।
  • ঝুঁকি বন্টন: সমিতির কোনো উদ্যোগে লোকসান হলে সেই ঝুঁকি কোনো একজন ব্যক্তির ওপর না পড়ে সকল সদস্যের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়, ফলে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যায়।

অসুবিধাসমূহ (The Disadvantages)

  • মূলধনের সীমাবদ্ধতা: সমবায় সমিতির সদস্যরা সাধারণত নিম্ন বা মধ্যম আয়ের মানুষ হন। তাই তাদের পক্ষে খুব বেশি শেয়ার কেনা বা সঞ্চয় করা সম্ভব হয় না। ফলে, বড় আকারের পুঁজি গঠন করা কঠিন হয়ে পড়ে, যা সমিতির বড় কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
  • অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণের অভাব: সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা সদস্যদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হন। তাদের হয়তো সততা এবং সদিচ্ছা থাকে, কিন্তু পেশাদার ব্যবস্থাপক বা ব্যবসায়িক জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব থাকতে পারে। ভুল ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তের কারণে অনেক সম্ভাবনাময় সমবায়ও ব্যর্থ হয়ে যায়। একারণেই ‘শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ’ নীতিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ ও দলাদলি: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি নেতিবাচক দিক হলো, এখানে ব্যক্তিগত সংঘাত, ক্ষমতার লোভ এবং দলাদলির সুযোগ থাকে। যদি সদস্যদের মধ্যে ঐক্য এবং সহযোগিতার মানসিকতার চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে, তবে সমিতি তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে।
  • অতিরিক্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণ: সমবায় সমিতিগুলো আইনত সরকারি সমবায় দপ্তরের অধীনে থাকে। যদিও এই নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য হলো সমিতির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, কিন্তু অনেক সময় অতিরিক্ত তদারকি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সমিতির স্বায়ত্তশাসনকে খর্ব করে।

বাংলাদেশে সমবায় সমিতি গঠন প্রক্রিয়া (Step by step guide)

আপনি যদি সমমনা কিছু মানুষকে নিয়ে একটি সমবায় সমিতি গঠন করতে আগ্রহী হন, তবে আপনাকে সমবায় আইন, ২০০১ এবং সমবায় বিধিমালা, ২০০৪ অনুযায়ী কিছু ধাপ অনুসরণ করতে হবে।

  • ধাপ ১: উদ্যোক্তা সংগ্রহ ও প্রাথমিক সভা: প্রথমত, আপনাকে আপনার এলাকার বা পেশার সমমনা এবং সম-স্বার্থের কমপক্ষে ২০ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে একত্রিত করতে হবে। এরপর একটি প্রাথমিক সভা আহ্বান করে সমিতির উদ্দেশ্য, কার্যক্রমের ধরণ এবং সম্ভাব্য নাম নিয়ে আলোচনা করতে হবে। এই সভাতেই একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি নির্বাচন করা হয়, যারা নিবন্ধনের পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার দায়িত্বে থাকবেন।
  • ধাপ ২: উপ-আইন বা বাই-ল তৈরি (Drafting the By-laws): এটি সমিতির সংবিধান। সমবায় বিধিমালায় উল্লিখিত আদর্শ উপ-আইনের আলোকে আপনাদের সমিতির জন্য একটি খসড়া উপ-আইন তৈরি করতে হবে। এতে সাধারণত নিচের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে:
    • সমিতির নাম, ঠিকানা ও কর্ম এলাকা।
    • সমিতির সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য।
    • সদস্যদের যোগ্যতা, ভর্তি, অধিকার ও দায়িত্ব।
    • শেয়ারের মূল্য, চাঁদার পরিমাণ এবং মূলধন সংগ্রহের উপায়।
    • ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন, নির্বাচন, ক্ষমতা ও কার্যকাল।
    • সভা পরিচালনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিয়মাবলী।
    • উদ্বৃত্ত অর্থ বন্টনের নীতিমালা।
  • ধাপ ৩: নিবন্ধনের জন্য আবেদন: উপ-আইন চূড়ান্ত হওয়ার পর নিবন্ধনের জন্য আপনার এলাকার উপজেলা বা জেলা সমবায় কর্মকর্তার কার্যালয়ে আবেদন করতে হবে। আবেদনের সাথে সাধারণত নিচের কাগজপত্রগুলো জমা দিতে হয়:
    • নির্ধারিত আবেদনপত্র।
    • উপ-আইনের তিনটি কপি।
    • সকল প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের নাম, ঠিকানা, পেশা ও স্বাক্ষরসহ তালিকা।
    • প্রাথমিক সভার কার্যবিবরণী।
    • নির্ধারিত নিবন্ধন ফি জমা দেওয়ার রশিদ।
  • ধাপ ৪: নিবন্ধনপত্র ও উপ-আইন সংগ্রহ: আবেদন এবং সংযুক্ত কাগজপত্রগুলো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যাচাই-বাছাই করা হবে। সবকিছু আইন অনুযায়ী সঠিক থাকলে, সমবায় দপ্তর আপনার সমিতির নামে একটি নিবন্ধন নম্বর দেবে এবং নিবন্ধনপত্র (Registration Certificate) ইস্যু করবে। এটিই আপনার সমিতির আইনগত স্বীকৃতির দলিল। এর মাধ্যমে আপনার সমিতি একটি আইনগত সত্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

  • প্রশ্ন ১: সমবায় সমিতি চালাতে সর্বনিম্ন কতজন সদস্য প্রয়োজন?
    • উত্তর: বাংলাদেশে একটি প্রাথমিক সমবায় সমিতি গঠন ও পরিচালনার জন্য আইন অনুযায়ী সর্বনিম্ন ২০ (বিশ) জন সদস্য প্রয়োজন।
  • প্রশ্ন ২: ‘এক সদস্য, এক ভোট’ নীতিটি কী?
    • উত্তর: এই নীতির অর্থ হলো, একজন সদস্যের শেয়ার বা সঞ্চয়ের পরিমাণ যাই হোক না কেন, সমিতির যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি মাত্র একটিই ভোট দিতে পারবেন। এটি সমবায়ের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠা করে।
  • প্রশ্ন ৩: সমিতির লাভ বা উদ্বৃত্ত অর্থ কীভাবে বন্টিত হয়?
    • উত্তর: সমিতির অর্জিত উদ্বৃত্তের একটি নির্দিষ্ট অংশ (সাধারণত ১৫%) ‘সংরক্ষিত তহবিল’-এ জমা রাখা হয়। বাকি অংশ থেকে একটি অংশ সদস্যদের মাঝে তাদের শেয়ারের অনুপাতে এবং বড় একটি অংশ তাদের লেনদেনের অনুপাতে (Patronage Refund) বন্টন করা হয়।
  • প্রশ্ন ৪: সমবায় সমিতি কি যেকোনো ধরনের ব্যবসা করতে পারে?
    • উত্তর: হ্যাঁ, পারে। তবে সেই ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য হতে হবে সদস্যদের সেবা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং তা অবশ্যই সমিতির নিবন্ধিত উপ-আইনে উল্লিখিত উদ্দেশ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে।

উপসংহার: সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি

আলোচনার শেষে আমরা দেখতে পাই, সমবায় সমিতি কেবল একটি ব্যবসায়িক মডেল নয়, এটি একটি পরিপূর্ণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলন। এটি এমন এক দর্শন যা সাধারণ মানুষকে শেখায় যে, বিচ্ছিন্নভাবে একা একা লড়াই করার চেয়ে সম্মিলিতভাবে একে অপরের হাত ধরে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি অনেক বেশি। পুঁজিবাদের চরম প্রতিযোগিতার বিশ্বে, সমবায় হলো সহযোগিতা, সাম্য এবং গণতন্ত্রের এক মূর্ত প্রতীক।

একটি সমবায় সমিতির সাফল্য শুধুমাত্র এর আর্থিক লাভের ওপর নির্ভর করে না, বরং নির্ভর করে এর সদস্যদের সততা, একতা, পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর। যখন সদস্যরা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সমিতির বৃহত্তর কল্যাণের জন্য কাজ করে, তখনই একটি সমবায় তার আসল উদ্দেশ্য পূরণে সক্ষম হয়।

রহিম চাচার ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা থেকে শুরু করে মিসেস আনোয়ারার জরুরি প্রয়োজনে আর্থিক সুরক্ষা দেওয়া পর্যন্ত—সমবায় প্রমাণ করে যে, সাধারণ মানুষ যখন একত্রিত হয়, তখন তারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের অসাধারণ ক্ষমতা রাখে। এটিই হলো সমবায়ের মূল শক্তি, যা আত্মনির্ভরশীল এবং শোষণমুক্ত একটি সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখায়। একতাই বল—এই চিরন্তন সত্যকে ধারণ করেই সমবায় সমিতি আগামীতেও সম্মিলিত সাফল্যের পথে এগিয়ে যাবে।

Leave a Comment

সম্পর্কিত পোস্টসমূহ

আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

Scroll to Top