তরুণের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প (A young man’s story of turning around)
আমাদের সবারই কিছু স্বপ্ন থাকে। কারও স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ার, কারও বা সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার। কিন্তু কিছু স্বপ্ন থাকে, যার শেকড় থাকে মাটির অনেক গভীরে। সেই স্বপ্নগুলো জন্ম নেয় গ্রামের ধুলোমাখা পথে, বাবার ঘামে ভেজা শার্টের গন্ধে আর মায়ের স্নেহের আঁচলে। এই স্বপ্নগুলো হয়তো চাকচিক্যময় নয়, কিন্তু এগুলো খাঁটি। আজ আমরা তেমনই এক মাটির কাছাকাছি থাকা স্বপ্নের গল্প শুনব। এ গল্প বাংলাদেশের এক সাধারণ গ্রাম সোনাপুরের এক অসাধারণ তরুণ রহিম শেখের। এ গল্প শুধু একটি গরুর খামার তৈরির নয়, এ গল্প হতাশার আঁধার থেকে উঠে এসে নিজের ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ার। চলুন, ডুব দেওয়া যাক রহিমের সেই আশ্চর্য জগতে, যেখানে শ্রম, সততা আর স্বপ্ন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
যেখানে স্বপ্নের বীজ বোনা হয়েছিল (Dreams)
সোনাপুর গ্রামের আর দশটা ছেলের মতোই বেড়ে উঠছিল রহিম। তার পৃথিবীটা ছিল সবুজ ধানক্ষেত, পুকুরের টলটলে জল আর ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধে ভরা। ছোটবেলা থেকেই সে দেখেছে তার বাবা, শেখ আকবর আলীকে। একজন প্রান্তিক কৃষক, যাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে এক চিলতে জমিতে সোনার ফসল ফলানো। রহিম দেখত, কীভাবে হাড়ভাঙা খাটুনির পর তার বাবা বাড়ি ফিরতেন, কিন্তু মহাজনের দেনা আর সংসারের টানাটানি তাঁর মুখের হাসি কেড়ে নিত। এই দারিদ্র্য আর সংগ্রাম রহিমের কচি মনে এক গভীর ছাপ ফেলেছিল।
তবে তার শৈশবে এক ঝলক আনন্দের হাওয়া নিয়ে আসত গ্রামের শেষ মাথায় থাকা করিম চাচার গোয়ালঘর। স্কুল থেকে ফিরেই তার মন পড়ে থাকত সেখানে। করিম চাচার ‘লক্ষ্মী’ নামের লাল গাইটার সাথে তার গড়ে উঠেছিল এক অদ্ভুত সখ্যতা। সে পরম যত্নে লক্ষ্মীর জন্য ঘাস কেটে আনত, তাকে পানি খাওয়াত, আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার পাশে বসে থাকত। করিম চাচাও তাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনিই রহিমকে হাতে-কলমে শিখিয়েছিলেন গরুর যত্নআত্তির খুঁটিনাটি—কোন মৌসুমে কী রোগ হয়, ভালো ঘাসের জাত কীভাবে চিনতে হয়, দুধ দোহানোর সঠিক নিয়ম কী।
কলেজের বইয়ের পাতার চেয়ে এই বাস্তব জ্ঞান রহিমকে অনেক বেশি টানত। সে অনুভব করত, এই পশুদের বোবা চোখের ভাষায় এক অদ্ভুত শান্তি আছে। তখন সে নিজেও জানত না যে, এই মাটির প্রতি টান, পশুদের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর বাবার নীরব সংগ্রামই একদিন তার জীবনের সবচেয়ে বড় পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবে। তার ভেতরে অজান্তেই একজন কৃষকের সহনশীলতা এবং একজন স্বপ্নবাজের আকাঙ্ক্ষা একই সাথে বেড়ে উঠছিল, যা ছিল তার ভবিষ্যতের ভিত্তি।
ব্যবসার প্রেরণা পাওয়া (Business motivation)
কলেজের ডিগ্রিটা হাতে নিয়ে রহিম ভেবেছিল, এবার হয়তো দিন বদলাবে। কিন্তু বাস্তব ছিল কঠিন। চাকরির আশায় শহরের অলিগলিতে ছয় মাস জুতার তলা ক্ষয় করেও কোনো লাভ হলো না। প্রতিটি ‘না’ তার আত্মবিশ্বাসকে একটু একটু করে ভেঙে দিচ্ছিল। বাড়িতে বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ আর বোনের কলেজের বেতনের চিন্তা তাকে প্রতি রাতে অস্থির করে তুলত। তার মনে হচ্ছিল, সে এক অথৈ সাগরে দিকচিহ্নহীন নাবিকের মতো ভেসে চলেছে।
এই হতাশার মাঝেই একদিন সে গেল পাশের উপজেলায় আয়োজিত এক বিশাল কৃষি মেলায়। চারদিকে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি, হাইব্রিড ফসলের প্রদর্শনী। কিন্তু রহিমের চোখ আটকে গেল একটি স্টলে, যেখানে উন্নত জাতের একটি বিশাল ফ্রিজিয়ান গাভী দাঁড়িয়ে ছিল। তার স্বাস্থ্য, আকার আর শান্ত ভঙ্গি—সবকিছুই ছিল মুগ্ধ করার মতো। স্টলের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা মাইক্রোফোনে বলছিলেন, “আপনারা যা দেখছেন, তা শুধু একটি পশু নয়, এটি একটি চলমান ডেইরি প্রজেক্ট। সঠিক পরিচর্যা, সুষম খাদ্য আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে একে পালন করলে এই এক গাভীই মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকার দুধ দেয়, যা একজন সাধারণ চাকুরিজীবীর বেতনের চেয়েও বেশি।”
এই কথাগুলো রহিমের কানে নয়, একেবারে হৃদয়ে গিয়ে বিঁধল। তার চোখের সামনে সোনাপুরের শত শত অবহেলিত গরুর ছবি ভেসে উঠল। সে বুঝতে পারল, যে কাজটি তার গ্রামের মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কেবল টিকে থাকার জন্য করে আসছে, তার মধ্যেই আধুনিক বিজ্ঞান ও সঠিক পরিকল্পনার ছোঁয়ায় লুকিয়ে আছে এক বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। সে উপলব্ধি করল, আন্তর্জাতিক বাজারে ডেইরি একটি বিলিয়ন ডলারের শিল্প, আর সঠিক পথে হাঁটলে তার ছোট গ্রামটিও এই বিপ্লবের অংশ হতে পারে।
সেই রাতেই তার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। সে সিদ্ধান্ত নিল, আর চাকরির পেছনে ছোটা নয়। সে তার শৈশবের জ্ঞান, আধুনিক প্রযুক্তি আর নিজের পরিশ্রমকে এক সুতোয় গেঁথে সোনাপুর গ্রামেই এক নতুন ইতিহাস লিখবে। তার স্বপ্ন আর চাকরির আবেদনপত্রে সীমাবদ্ধ রইল না, ছড়িয়ে পড়ল তার গ্রামের মাটির প্রতিটি কণার সাথে।
প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ (The primary challenge)
স্বপ্ন দেখা যত সহজ, তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া ততটাই কঠিন। রহিম যখন রাতের খাবারের পর তার পরিবারকে খামারের পরিকল্পনার কথা শোনাল, তখন তার বাবা শেখ আকবর আলী খাওয়া থামিয়ে দিলেন। তাঁর চোখে ছিল রাজ্যের বিস্ময় আর চাপা হতাশা। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “চাকরি না পেয়ে এখন গোয়ালার কাজ করবি? এতগুলো বছর তোকে পড়াশোনা করালাম কি ঘাস কাটার জন্য? লোকে কী বলবে? শেখ বাড়ির ছেলে হয়ে তুই দুধ বিক্রি করবি?” বাবার প্রতিটি শব্দ রহিমের বুকে তীরের মতো বিঁধছিল। সে বাবাকে বোঝাতে চেয়েছিল, এটা শুধু দুধ বিক্রি নয়, এটা একটা ব্যবসা, একটা সম্মানজনক পেশা। কিন্তু বাবা বুঝতে চাইলেন না।
পারিবারিক বাধার পর এলো অর্থনৈতিক বাধা। রহিম যখন স্থানীয় সমবায় সমিতিতে ঋণের জন্য আবেদন করল, তখন ম্যানেজার তার বয়স আর অভিজ্ঞতার অভাব দেখে আবেদনপত্রটি একপাশে সরিয়ে রাখলেন। বললেন, “এইসব খামারে অনেক ঝুঁকি। অভিজ্ঞতা ছাড়া এত বড় ঝুঁকি নিয়ে আমরা ঋণ দিতে পারব না।”
এদিকে গ্রামের চায়ের দোকানে তাকে নিয়ে শুরু হলো কানাঘুষা আর বিদ্রূপ। কেউ তাকে ‘পাগল’ বলল, কেউ বলল ‘বাপের পয়সা নষ্ট করার নতুন ফন্দি’। তার কলেজের বন্ধুরা পর্যন্ত তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে ‘পড়াশোনা করা গোয়ালা’ বলে ডাকতে শুরু করল। সামাজিক চাপ, পারিবারিক অসম্মতি আর পুঁজির অভাব—এই তিন বাধার দুর্ভেদ্য দেয়ালে তার স্বপ্নগুলো যেন মুখ থুবড়ে পড়ল। রাতের পর রাত তার ঘুম আসত না। তার মনে হতো, সে একা এক বিশাল পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নেমেছে, যেখানে তার কোনো সেনাবাহিনী নেই।
প্রথম উদ্যোগ (First initiative)
চারিদিক থেকে যখন সব দরজা বন্ধ, তখন এক টুকরো আশার আলো হয়ে রহিমের পাশে এসে দাঁড়ালেন তার মা। এক রাতে তিনি রহিমের মাথায় হাত রাখতে রাখতে তার আঁচলের ভেতর থেকে একটা পুরোনো কাপড়ের পুঁটুলি বের করলেন। তাতে ছিল তার বহু বছরের জমানো সামান্য কিছু টাকা আর একজোড়া সোনার দুল, যা ছিল তার বিয়ের স্মৃতিচিহ্ন। ছেলের হাতে টাকাটা দিয়ে তিনি ভেজা গলায় বললেন, “তোর বাপের কথায় কষ্ট নিস না। সে তোর ভালো চায় বলেই ভয় পায়। আমি জানি, আমার ছেলে যা ধরে, তা সোনা হয়ে যায়। তুই শুরু কর, আল্লাহ ভরসা।”
মায়ের এই নিঃশর্ত বিশ্বাস রহিমের শুকিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাসে যেন এক পশলা বৃষ্টির মতো কাজ করল। ছেলের চোখের জেদ আর স্ত্রীর আত্মত্যাগ দেখে শেখ আকবর আলীর কঠিন মনও কিছুটা নরম হলো। তিনি আর কিছু না বলে, তার শেষ সম্বল, এক টুকরো জমি বন্ধক রেখে সমিতি থেকে সামান্য কিছু ঋণের ব্যবস্থা করে দিলেন।
হাতে যা টাকা এলো, তা দিয়ে পরিকল্পনা মতো উন্নত জাতের দুটি গাভী কেনা সম্ভব ছিল না। রহিম বাস্তবতার সাথে আপস করল। সে বাজার ঘুরে একটি ভালো সংকর জাতের গর্ভবতী গাভী আর একটি দেশি গাভী কিনল। মিস্ত্রি ডাকার পয়সা বাঁচিয়ে সে নিজেই কাঠ-টিন জোগাড় করে, দিনরাত খেটে বাড়ির পাশে একটি ছোট কিন্তু মজবুত ও পরিচ্ছন্ন গোয়ালঘর তৈরি করল। যেদিন সে প্রথম বাছুরসহ গাভী দুটিকে সেই ঘরে আনল, সেদিন তার মনে হচ্ছিল সে যেন এক নতুন রাজ্য জয় করেছে। হাজারো বাধার পর, এটি ছিল তার স্বপ্নের বাস্তব রূপ, তার நம்பிக்கা আর জেদের প্রথম প্রদীপ।
সংগ্রাম ও ব্যর্থতা (Struggle and failure)
প্রথম কয়েক মাস রহিমের জীবনটা একটা ছন্দে চলছিল। খুব ভোরে উঠে গোয়ালঘর পরিষ্কার করা, গরুকে খাবার দেওয়া, দুধ দোহানো, আর তারপর সেই দুধ বিক্রি করা—এই ছিল তার রুটিন। দুধ বিক্রি করে ঋণের কিস্তি আর গরুর খাবারের খরচ কোনোমতে উঠে আসছিল। কিন্তু রহিমের ভাগ্যাকাশে তখনো কালো মেঘ জমার বাকি ছিল।
বর্ষার এক স্যাঁতসেঁতে সকালে সে দেখল, তার সবচেয়ে ভালো সংকর জাতের গাভীটি ঠিকমতো খেতে পারছে না, তার ওলান ফুলে শক্ত হয়ে গেছে। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার এসে দেখে বললেন, মারাত্মক ম্যাসটাইটিস (ওলান পাকা রোগ) হয়েছে। চিকিৎসা শুরু হলো, কিন্তু গাভীর অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে লাগল। দুধ দেওয়া প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। এদিকে চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে রহিমের জমানো শেষ টাকাটুকুও বেরিয়ে গেল। ঋণের কিস্তির তারিখ ঘনিয়ে আসছিল।
এই সুযোগে গ্রামের ধূর্ত দুধের ব্যাপারী হাসমত মিয়া তার খামারে এসে হাজির হলো। সে রহিমের অসহায় অবস্থা দেখে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “শখ করে তো গোয়ালা হইছ। এখন বোঝ ঠেলা। যা দুধ হয়, অর্ধেক দামে আমার কাছে বেচে দে, নাহলে এই গরু নিয়ে পথে বসবি।” হাসমতের কথাগুলো রহিমের বুকে ছুরির মতো আঘাত করল।
এক অমাবস্যার রাতে গোয়ালঘরে বসে অসুস্থ গাভীটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে রহিমের দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তার মনে হলো, সে সবদিক থেকে হেরে গেছে। বাবার কথাগুলো তার কানে বাজতে লাগল। তার মনে হলো, খামার বন্ধ করে দিয়ে শহরের কোনো কারখানায় কাজ নেওয়াই হয়তো তার ভবিতব্য। স্বপ্ন দেখার বিলাসিতা হয়তো তার মতো গরিবের জন্য নয়।
ধীরে ধীরে সাফল্যের দেখা (Success)
হতাশার গভীরতম বিন্দুতে পৌঁছেও রহিমের ভেতরের যোদ্ধাটি পুরোপুরি মরে যায়নি। সে তার মায়ের মুখের দিকে তাকাল, তার বোনের ভবিষ্যতের কথা ভাবল। সে হারতে পারে না। পরদিন ভোরে সে তার পুরনো সাইকেলটা নিয়ে ৪০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা পশু হাসপাতালে গেল। সেখানকার একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার তার সব কথা শুনে নতুন চিকিৎসার পরামর্শ দিলেন। রহিম দিনরাত এক করে, নিজের খাওয়া-ঘুম ভুলে গাভীটির সেবা করতে লাগল। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে আর সঠিক চিকিৎসায় গাভীটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল এবং অল্প অল্প করে দুধ দিতে শুরু করল।
এই ধাক্কাটা রহিমকে একটি মূল্যবান শিক্ষা দিল। সে বুঝতে পারল, হাসমত ব্যাপারীর মতো মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভর করে এই ব্যবসায় টেকা যাবে না। তাকে নিজের বাজার নিজেকেই তৈরি করতে হবে। সে একটি নতুন কৌশল নিল। সাইকেলের পেছনে দুধের ক্যান চাপিয়ে সে পাশের ছোট শহরে সরাসরি গ্রাহকদের বাড়িতে দুধ বিক্রি শুরু করল।
প্রথম দিকে অনেকেই তাকে ফিরিয়ে দিত, কিন্তু রহিম হাল ছাড়েনি। দরজায় দরজায় গিয়ে সে তার দুধের বিশুদ্ধতার কথা বলত। যারা একবার তার কাছ থেকে দুধ নিত, তারা খাঁটি দুধের স্বাদ পেয়ে তার স্থায়ী গ্রাহক হয়ে যেত। মানুষের মুখে মুখেই তার সততার কথা ছড়িয়ে পড়ল। “রহিমের খাঁটি দুধ” নামে একটা পরিচিতি তৈরি হলো। পাশাপাশি, সে গোবর থেকে জৈব সার তৈরি করে স্থানীয় নার্সারি ও সবজি চাষীদের কাছে বিক্রি শুরু করল। এটি তার একটি বাড়তি আয়ের পথ খুলে দিল। সে হয়তো তখনো বিরাট লাভ করছিল না, কিন্তু সে নিজের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছিল এবং সবচেয়ে বড় কথা, সে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেছিল।
ব্যবসার প্রসার (Business expansion)
পরবর্তী তিন বছর ছিল রহিমের নিরলস পরিশ্রম আর মেধার ফসল। তার খামারের গাভীর সংখ্যা দুই থেকে বেড়ে দশটিতে পৌঁছাল। এখন তার খামারের প্রতিটি গাভীই সুস্থ ও সবল। যে সাইকেল নিয়ে সে একদিন দুধ বিক্রি শুরু করেছিল, তার জায়গায় এখন একটি ছোট মোটরবাইক। ‘সোনাপুর ডেইরি’ নামে তার খামারের একটি ব্র্যান্ড পরিচিতি তৈরি হয়েছে, যা বিশুদ্ধতা ও আস্থার প্রতীক।
রহিম শুধু দুধ বিক্রিতেই থেমে থাকেনি। সে শিখেছে কীভাবে পণ্যের মূল্য সংযোজন (Value Addition) করতে হয়। সে এখন খাঁটি দুধ থেকে ঘি এবং মিষ্টি দই তৈরি করে, যা শহরের দোকানগুলোতে বেশ ভালো দামে বিক্রি হয়। যে সমবায় সমিতি তাকে একদিন ফিরিয়ে দিয়েছিল, তারাই এখন তাকে বড় আকারের কৃষিঋণ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে তার ব্যক্তিগত জীবনে। সে এখন গ্রামের আরও দুজন বেকার যুবককে তার খামারে চাকরি দিয়েছে। মাস গেলে তাদের হাতে বেতন তুলে দেওয়ার সময় তার বুকটা গর্বে ভরে ওঠে। সে এখন শুধু একজন খামারি নয়, সে একজন উদ্যোক্তা, একজন চাকরিদাতা। যে বাবা একদিন তাকে তিরস্কার করেছিলেন, সেই শেখ আকবর আলী এখন গ্রামের চায়ের দোকানে বসে গর্বের সাথে সবার কাছে ছেলের সাফল্যের গল্প বলেন। রহিমের খামারটি এখন শুধু তার পরিবারের আয়ের উৎস নয়, বরং সোনাপুর গ্রামের জন্য একটি আশার বাতিঘর।
শিক্ষণীয় অংশ (Business Lessons from Rahim’s Journey)
রহিম শেখের গল্প শুধু একটি অনুপ্রেরণামূলক কাহিনি নয়, এটি যেকোনো নবীন উদ্যোক্তার জন্য একটি জীবন্ত কেস স্টাডি। তার এই যাত্রা থেকে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক শিক্ষা নিতে পারি:
- ছোট থেকে শুরু করুন, কিন্তু স্বপ্ন দেখুন বড়: রহিম একবারে দশটি গরু দিয়ে খামার শুরু করেনি। সে তার সামর্থ্য অনুযায়ী দুটি গরু দিয়ে শুরু করেছিল। ব্যবসার ভিত্তি মজবুত হলে, তা সময়ের সাথে সাথে自然ভাবেই বড় হয়।
- সমস্যার সমাধান করুন, ব্যবসা নিজে থেকেই হবে: রহিম শুধু দুধ বিক্রি করেনি, সে শহরের মানুষের “খাঁটি দুধের অভাব”–এই সমস্যার সমাধান করেছে। আপনার পণ্য বা পরিষেবা যদি মানুষের কোনো বাস্তব সমস্যার সমাধান করে, তবে গ্রাহক আপনাকে খুঁজে নেবেই।
- মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়িয়ে চলুন: রহিমের ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে সবচেয়ে বড় কৌশল ছিল সরাসরি গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো (Direct-to-Consumer মডেল)। এতে সে পণ্যের সঠিক দাম পেয়েছে এবং গ্রাহকের সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছে।
- পণ্যের মূল্য সংযোজন করুন: শুধু কাঁচামাল বিক্রি না করে, তা থেকে অন্য পণ্য তৈরি করতে পারলে লাভ বহুগুণ বেড়ে যায়। দুধ থেকে ঘি ও দই তৈরি করে রহিম यही প্রমাণ করেছে।
- ব্যর্থতা শেষ নয়, নতুন করে শেখার সুযোগ: অসুস্থ গাভীটির ঘটনাটি ছিল রহিমের জন্য একটি বড় ধাক্কা, কিন্তু সেই ব্যর্থতা থেকেই সে নতুন করে লড়াই করার এবং নতুন ব্যবসায়িক কৌশল তৈরির শিক্ষা পেয়েছিল।
- সততাই আপনার সেরা ব্র্যান্ড: হাজারো মার্কেটিং কৌশলের চেয়েও শক্তিশালী হলো সততা। “রহিমের খাঁটি দুধ” এই বিশ্বাসটুকু অর্জন করতে পেরেছিল বলেই তার ব্যবসা সফল হয়েছে।
উপসংহার (Conclusion)
রহিম শেখের গল্প আমাদের শেখায় যে, স্বপ্ন পূরণের জন্য বিশাল অট্টালিকা বা কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় একটি অদম্য ইচ্ছা, কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা আর সততার সাথে লেগে থাকার জেদ। তার গল্প প্রমাণ করে, আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য সম্ভাবনা, শুধু প্রয়োজন সেগুলোকে চিনে নেওয়ার মতো একটি চোখ।
আজ রহিম শুধু সোনাপুরের একজন সফল উদ্যোক্তাই নয়, সে সেই সব তরুণদের জন্য এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা, যারা সঠিক সুযোগের অভাবে নিজেদের প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারছে না। সে দেখিয়েছে, কীভাবে গ্রামের কাদামাটি থেকেই সাফল্যের আকাশ ছোঁয়া যায়। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই একজন রহিম লুকিয়ে আছে, যে প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে নিজের স্বপ্নকে সত্যি করতে চায়। এখন শুধু প্রয়োজন প্রথম পদক্ষেপটি নেওয়ার। আপনার ‘সোনাপুর’ কোনটি? আপনার স্বপ্ন কী? খুঁজে বের করুন এবং রহিমের মতো করেই শুরু করে দিন আপনার নিজের গল্প।