বাংলাদেশি সফল ১০ উদ্যোক্তা ও বর্তমান অবস্থান: তাদের সাফল্যের গল্প ও অনুপ্রেরণা

বাংলাদেশি সফল ১০ উদ্যোক্তা ও বর্তমান অবস্থান: তাদের সাফল্যের গল্প ও অনুপ্রেরণা

বাংলাদেশি সফল ১০ উদ্যোক্তা ও বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান? এই পোস্টে জানুন দেশের সেরা ১০ জন উদ্যোক্তার জীবনের গল্প, তাদের উদ্যোগ এবং বর্তমানে তারা কোথায় আছেন।

Table of Contents

বাংলাদেশি সফল ১০ উদ্যোক্তা ও তাদের বর্তমান অবস্থান: অনুপ্রেরণার এক অনন্য অধ্যায়

ভূমিকা (Introduction)

“উদ্যোক্তা” শব্দটি শুনলে আপনার মনে কী ভেসে ওঠে? হয়তো চোখে ভাসে সফল কোনো মানুষের ছবি, যার রয়েছে বিশাল ব্যবসা, দামি গাড়ি আর বিলাসবহুল জীবন। কিন্তু এই ছবির পেছনের গল্পটা কী? পেছনের গল্পটা হলো স্বপ্ন দেখার, ঝুঁকি নেওয়ার, রাতের পর রাত জেগে কাজ করার এবং শত শত বার ব্যর্থ হয়েও হাল না ছাড়ার। “উদ্যোক্তা” শব্দটি শুধু একটি পেশা নয়, এটি একটি স্বপ্ন, একটি সংগ্রাম এবং অবশেষে সাফল্যের এক মহাকাব্য।

বাংলাদেশ, অপার সম্ভাবনার এক দেশ। এই উর্বর ভূমিতে যেমন সোনা ফলে, তেমনই জন্ম নিয়েছেন বহু কীর্তিমান মানুষ, যারা নিজেদের মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। তারা শূন্য থেকে শুরু করে নিজেদের তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন, তৈরি করেছেন বিশাল শিল্প সাম্রাজ্য। এই ব্লগে আমরা বাংলাদেশের তেমনই ১০ জন কিংবদন্তি উদ্যোক্তার কথা তুলে ধরব, যারা শুধু নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেননি, বরং লাখো মানুষের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করে দেশের অর্থনীতিতে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তাদের সংগ্রামের পথ, সাফল্যের কৌশল এবং বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে এমন কিছু অজানা কথা আমরা জানব, যা নতুন প্রজন্মের প্রতিটি স্বপ্নবাজ তরুণের জন্য অনুপ্রেরণার এক অফুরন্ত উৎস হয়ে থাকবে। চলুন, শুরু করা যাক সেইসব মানুষদের নিয়ে, যারা শিখিয়েছেন কীভাবে স্বপ্নের পেছনে ছুটতে হয়।

কেন উদ্যোক্তাদের গল্প আমাদের জানা প্রয়োজন?

আমরা প্রায়ই সফল মানুষদের দেখি, কিন্তু তাদের সফল হওয়ার পেছনের কঠিন পথটা দেখি না। একজন উদ্যোক্তার জীবন কাহিনী শুধু একটি ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয়, এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের জীবন্ত দলিল। তাদের গল্প জানা আমাদের জন্য একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ।

  • অনুপ্রেরণার উৎস: প্রতিটি সফল উদ্যোক্তার জীবনে এমন অনেক মুহূর্ত আসে যখন সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম, চারদিকে ঋণের বোঝা, মানসিক চাপ—এইসব প্রতিকূলতা তারা কীভাবে মোকাবেলা করেছেন, সেই গল্পগুলো আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। যেমন, যখন ‘বিকাশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা কামাল কাদীর দেখলেন যে দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছাচ্ছে না, তখন তিনি সেই সমস্যা সমাধানের স্বপ্ন দেখলেন। তার এই স্বপ্ন আজ কোটি মানুষের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। এই গল্পগুলো আমাদের শেখায়, সমস্যা দেখে ভয় পেতে নেই, বরং তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে নতুন সম্ভাবনা। ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর এবং কঠিন সময়ে упор করার মানসিকতা তৈরিতে এই বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো টনিকের মতো কাজ করে।

  • বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা: বই পড়ে হয়তো ব্যবসার কৌশল শেখা যায়, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা бесцен্য। সফল উদ্যোক্তাদের নেওয়া প্রতিটি সিদ্ধান্ত, তাদের করা প্রতিটি ভুল আমাদের জন্য এক একটি কেস স্টাডি। সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী যখন অ্যাপেক্স গ্রুপ শুরু করেন, তখন বাংলাদেশের চামড়া শিল্প আজকের মতো এতটা উন্নত ছিল না। তিনি কীভাবে আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা বুঝে নিজের ব্যবসাকে সাজিয়েছেন, কোন ধরনের পণ্যে বিনিয়োগ করেছেন এবং গুণগত মান ধরে রেখেছেন—এগুলো থেকে একজন নতুন উদ্যোক্তা অনেক কিছু শিখতে পারেন। তাদের ভুল এবং সঠিক সিদ্ধান্তগুলো বিশ্লেষণ করে আমরা আমাদের চলার পথকে আরও মসৃণ করতে পারি।

  • দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদান: উদ্যোক্তারা হলেন একটি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। আহমেদ আকবর সোবহানের বসুন্ধরা গ্রুপ শুধু রিয়েল এস্টেট নয়, সিমেন্ট থেকে শুরু করে মিডিয়া পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি খাতে বিশাল অবদান রাখছে। তাদের একটি উদ্যোগের ফলে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়, নতুন প্রযুক্তি আসে এবং দেশীয় শিল্পের বিকাশ ঘটে। যখন আমরা তাদের গল্প জানি, তখন আমরা বুঝতে পারি যে একজন ব্যক্তি তার মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে কীভাবে দেশের জিডিপিতে ভূমিকা রাখতে পারেন। এটি আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম এবং দেশের জন্য কিছু করার আগ্রহ তৈরি করে।

বাংলাদেশের সেরা ১০ জন সফল উদ্যোক্তা ও তাদের যাত্রা

এখানে আমরা এমন কয়েকজন দূরদর্শী মানুষের কথা বলব, যাদের নাম বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

১. স্যার ফজলে হাসান আবেদ – ব্র্যাক (BRAC)

  • পরিচয় ও প্রাথমিক জীবন

    স্যার ফজলে হাসান আবেদের জন্ম ১৯৩৬ সালে হবিগঞ্জের বানিয়াচং গ্রামে। তার পরিবার ছিল এলাকার জমিদার। পড়াশোনায় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হলেও পরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেভাল আর্কিটেকচার নিয়ে পড়তে যান। কিন্তু সেই বিষয় তার ভালো লাগেনি। এরপর তিনি লন্ডনে গিয়ে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পড়া শুরু করেন এবং ১৯৬২ সালে তার পড়ালেখা শেষ করেন। দেশে ফিরে এসে তিনি শেল অয়েল কোম্পানিতে হেড অফ ফিন্যান্স হিসেবে যোগ দেন এবং দ্রুতই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে আসীন হন। তার সামনে ছিল এক উজ্জ্বল কর্পোরেট ভবিষ্যৎ।

  • ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠা ও দর্শন

    ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। দেশের মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ দেখে তিনি তার নিশ্চিত ভবিষ্যতের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দেন। লন্ডনে নিজের ফ্ল্যাট বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ শুরু করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বুঝতে পারলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হলে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কোনো বিকল্প নেই। তাই ১৯৭২ সালে সুনামগঞ্জের শাল্লায় একটি ছোট ত্রাণ সংস্থা হিসেবে ‘বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্টেন্স কমিটি’ বা ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন।

    তার দর্শন ছিল প্রচলিত ত্রাণ কার্যক্রমের ঊর্ধ্বে। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষকে শুধু সাহায্য দিলেই হবে না, তাদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে হবে। তিনি দারিদ্র্যের মূল কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর জোর দেন। ব্র্যাকের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল এর ‘নন-ফরমাল প্রাইমারি এডুকেশন’ কার্যক্রম, যা میلیون লাখো শিশুকে স্কুলের আঙিনায় ফিরিয়ে এনেছে। তার হাতে গড়া ‘আরং’ আজ বাংলাদেশের অন্যতম সেরা লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড, যা হাজার হাজার গ্রামীণ কারুশিল্পীর জীবনে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছে। তিনি বলতেন, “ছোট ছোট উদ্যোগই বড় পরিবর্তন আনে।” এই দর্শন থেকেই ব্র্যাক আজ বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় পরিণত হয়েছে।

  • বর্তমান অবস্থান ও legado

    স্যার ফজলে হাসান আবেদ ২০১৯ সালে মৃত্যুবরণ করলেও তার রেখে যাওয়া legado আজও অম্লান। ব্র্যাক এখন শুধু বাংলাদেশে নয়, এশিয়া ও আফ্রিকার ১১টি দেশে তার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর কর্মী সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ, যাদের ৭০ শতাংশই নারী। ব্র্যাক ব্যাংক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ডেইরি—এরকম অসংখ্য সফল সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে ব্র্যাক নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে এবং উন্নয়নের এক টেকসই মডেল তৈরি করেছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ কোনো ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে সততা, মেধা এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা দিয়ে একটি ভঙ্গুর দেশকে আশার আলো দেখানো যায়।

২. ড. মুহাম্মদ ইউনূস – গ্রামীণ ব্যাংক (Grameen Bank)

  • ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা

    ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্ম ১৯৪০ সালে চট্টগ্রামে। তার বাবা ছিলেন একজন সফল জুয়েলারি ব্যবসায়ী। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল এবং চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা শেষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বি.এ. এবং এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচ.ডি. অর্জন করেন। দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তার জীবন ছিল একজন সাধারণ শিক্ষকের মতোই, যতক্ষণ না ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ তার চিন্তার জগতে এক বড় ধাক্কা দেয়।

  • গ্রামীণ ব্যাংকের সূচনা ও বৈশ্বিক প্রভাব

    দুর্ভিক্ষের সময় তিনি দেখতে পেলেন যে, তার পাঠ্যবইয়ের অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলো বাস্তব জীবনে গরিব মানুষের কোনো কাজেই আসছে না। তিনি তার ছাত্রদের নিয়ে পাশের গ্রাম ‘জোবরা’তে একটি সমীক্ষা চালান। সেখানে তিনি সুফিয়া বেগম নামে একজন নারীকে খুঁজে পান, যিনি বাঁশের মোড়া তৈরি করতেন। কিন্তু মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে মাত্র ২২ টাকা ঋণ নেওয়ার কারণে তার লাভের প্রায় পুরোটাই মহাজনকে দিয়ে দিতে হতো। ড. ইউনূস দেখলেন যে, গ্রামের ৪২ জন নারী মহাজনের কাছে মোট ৮৫৬ টাকার (প্রায় ২৭ মার্কিন ডলার) জন্য জিম্মি হয়ে আছেন। তিনি নিজের পকেট থেকে সেই টাকা পরিশোধ করে দিলেন এবং তাদের বললেন, ব্যবসা করে লাভ হওয়ার পর তারা যেন এই টাকা ফেরত দেয়।

    এই ছোট ঘটনা থেকেই তিনি বুঝতে পারলেন যে, গরিব মানুষকে যদি কোনো জামানত ছাড়া সামান্য পুঁজি দেওয়া যায়, তাহলে তারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প শুরু করেন, যা ১৯৮৩ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তার মডেল ছিল প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার ঠিক উল্টো। এখানে ঋণগ্রহীতারা, বিশেষ করে নারীরা, কোনো জামানত ছাড়াই ঋণ পান এবং সাপ্তাহিক কিস্তিতে তা পরিশোধ করেন। এই যুগান্তকারী ধারণার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক ২০০৬ সালে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। গ্রামীণ মডেল আজ বিশ্বের প্রায় ১০০টিরও বেশি দেশে সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

  • বর্তমান কার্যক্রম ও সামাজিক ব্যবসায়

    নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর ড. ইউনূস ‘সামাজিক ব্যবসা’ (Social Business) নামে একটি নতুন ধারণা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করছেন। সামাজিক ব্যবসা হলো এমন এক ধরনের ব্যবসা যার মূল উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন নয়, বরং কোনো একটি সামাজিক সমস্যার সমাধান করা। এই ব্যবসার মালিক কোনো লভ্যাংশ নেন না; অর্জিত মুনাফা পুনরায় সেই ব্যবসার প্রসারে বা নতুন কোনো সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হয়। ইউনূস সেন্টারের মাধ্যমে তিনি বর্তমানে এই ধারণা প্রচারে কাজ করে যাচ্ছেন। গ্রামীণ ড্যানোন, গ্রামীণ ইউনিক্লো-এর মতো বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন যে, ব্যবসার মাধ্যমেও পৃথিবীর ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। ড. ইউনূস প্রমাণ করেছেন যে, মানুষের প্রতি বিশ্বাস এবং একটি মহৎ উদ্দেশ্য থাকলে পুঁথিগতবিদ্যার বাইরেও অসাধারণ কিছু করা সম্ভব।

৩. আহমেদ আকবর সোবহান – বসুন্ধরা গ্রুপ (Bashundhara Group)

  • এক শিল্প বিপ্লবের স্বপ্নদ্রষ্টা

    আহমেদ আকবর সোবহান, যিনি শাহ আলম নামেও পরিচিত, বাংলাদেশের শিল্প জগতে এক জীবন্ত কিংবদন্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসনে পড়াশোনা শেষ করে তিনি ১৯৭৮ সালে অভ্যন্তরীণ ট্রেডিং কোম্পানি হিসেবে ‘বসুন্ধরা গ্রুপ’-এর যাত্রা শুরু করেন। তার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়—তিনি শুধু ব্যবসা করতে চাননি, তিনি চেয়েছিলেন দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করতে।

  • বসুন্ধরা গ্রুপের পথচলা ও বিস্তার

    ১৯৮৭ সালে তিনি ‘ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট (প্রাঃ) লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় প্রবেশ করেন, যা ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তখন বাংলাদেশে পরিকল্পিত আবাসন ছিল একটি নতুন ধারণা। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মাধ্যমে তিনি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের জন্য একটি আধুনিক ও নিরাপদ জীবনযাত্রার স্বপ্ন দেখান। এরপর তিনি আর পেছনে ফিরে তাকাননি। সিমেন্ট, কাগজ, টিস্যু, ইস্পাত, এলপি গ্যাস থেকে শুরু করে মিডিয়া (দৈনিক কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ডেইলি সান, নিউজ২৪, রেডিও ক্যাপিটাল), বসুন্ধরা গ্রুপ আজ দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী। তার সাফল্যের মূলমন্ত্র হলো সঠিক সময়ে সঠিক খাতে বিনিয়োগ করা এবং গুণগত মানের সঙ্গে কোনো আপস না করা। বসুন্ধরা সিটি শপিং মল নির্মাণ করে তিনি দেশের রিটেইল খাতে এক বিপ্লব এনেছেন।

  • বর্তমান অবস্থান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

    বর্তমানে বসুন্ধরা গ্রুপ দেশের অন্যতম শীর্ষ করদাতা প্রতিষ্ঠান এবং লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের উৎস। আহমেদ আকবর সোবহান এখন গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং তার সন্তানেরা ব্যবসার বিভিন্ন দিক দেখাশোনা করছেন। তার নেতৃত্বে গ্রুপটি এখন দেশের সর্ববৃহৎ স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। তিনি দেখিয়েছেন যে, অদম্য ইচ্ছা এবং দূরদৃষ্টি থাকলে একটি ছোট ট্রেডিং কোম্পানিকেও কীভাবে দেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভে পরিণত করা যায়।

৪. সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী – অ্যাপেক্স গ্রুপ (Apex Group)

  • এক দূরদর্শী উদ্যোক্তা

    সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী প্রমাণ করেছেন যে, একটি সফল কর্পোরেট ক্যারিয়ারের পরেও উদ্যোক্তা হিসেবে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি একাধারে চা বাগানের ব্যবস্থাপক, জুট মিলের নির্বাহী এবং পরবর্তীতে একটি বহুজাতিক ব্যাংকের কান্ট্রি হেড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল নিজের কিছু করার।

  • চামড়া শিল্পে অ্যাপেক্সের আধিপত্য

    ব্যাংকিং খাতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি দেশের সম্ভাবনাময় খাতগুলো নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং চামড়া শিল্পকে বেছে নেন। ১৯৭৫ সালে তিনি ‘অ্যাপেক্স ট্যানারি লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেন। তখন বাংলাদেশের চামড়া মূলত কাঁচামাল হিসেবে বিদেশে রপ্তানি হতো। তিনি এই ধারার পরিবর্তন করতে চাইলেন। তিনি শুধু চামড়া প্রক্রিয়াজাত করেননি, চামড়ার পণ্য তৈরি করে সরাসরি আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি শুরু করেন। ১৯৯০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড’, যা আজ দেশের সর্ববৃহৎ জুতা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। ইতালি, জার্মানি, জাপানসহ বিশ্বের নামীদামী ব্র্যান্ডগুলো আজ অ্যাপেক্সের কারখানায় তাদের জুতা তৈরি করে। “মেইড ইন বাংলাদেশ” ট্যাগকে তিনি বিশ্বজুড়ে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন।

  • বর্তমান অবস্থান ও অন্যান্য উদ্যোগ

    বর্তমানে অ্যাপেক্স গ্রুপ দেশের চামড়া শিল্পের পথিকৃৎ। সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী শুধু এখানেই থেমে থাকেননি। তিনি মিডিয়া (দ্য ডেইলি স্টার), ব্যাংক (মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক), বিমা এবং ফার্মাসিউটিক্যালস খাতেও সফলভাবে বিনিয়োগ করেছেন। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তার জীবন আমাদের শেখায় যে, বয়স বা পেশা কোনো বাধা নয়, স্বপ্ন দেখার এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন শুধু সাহস এবং সঠিক পরিকল্পনা।

৫. কামাল কাদীর – বিকাশ (bKash)

  • ডিজিটাল ফিন্যান্সের পথিকৃৎ

    কামাল কাদীর যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT) থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন। তিনি প্রবাসে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসেন নতুন কিছু করার প্রত্যয় নিয়ে। তার ভাই জামাল কাদীর এবং তিনি মিলে এর আগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেশের প্রথম অনলাইন মার্কেটপ্লেস ‘সেলবাজার’। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি দেশের একটি বড় সমস্যা অনুধাবন করতে পারেন।

  • বিকাশের জন্ম ও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব

    তিনি দেখলেন, দেশের অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে গ্রামের মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছায় না। টাকা পাঠানোর জন্য তাদের নির্ভর করতে হয় পরিচিত মানুষ বা অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমের ওপর, যা ছিল সময়সাপেক্ষ এবং ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি এই সমস্যার একটি সহজ সমাধান খুঁজছিলেন। মোবাইল ফোন তখন দেশের প্রায় প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেছে। তিনি ভাবলেন, এই মোবাইল নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করে যদি টাকা লেনদেনের একটি ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে কেমন হয়? এই চিন্তা থেকেই ২০১১ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের একটি সাবসিডিয়ারি হিসেবে ‘বিকাশ’-এর জন্ম। বিকাশের মডেলটি ছিল অত্যন্ত সহজ—যেকোনো সাধারণ ফিচার ফোন ব্যবহার করে একজন গ্রাহক টাকা পাঠানো, ক্যাশ আউট করা এবং পেমেন্ট করতে পারেন। এই সহজবোধ্য মডেলটিই বিকাশের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

  • বিকাশের বর্তমান অবস্থান ও ভবিষ্যৎ

    বিকাশ আজ শুধু একটি মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) নয়, এটি এখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্তমানে এর গ্রাহক সংখ্যা ৭ কোটিরও বেশি। বিল পেমেন্ট, অনলাইন কেনাকাটা, বেতন প্রদান থেকে শুরু করে সঞ্চয়—সবকিছুই এখন বিকাশের মাধ্যমে সম্ভব। এটি দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। কামাল কাদীর দেখিয়েছেন যে, প্রযুক্ত জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করা হলে, এটি দেশের অর্থনীতির চিত্র বদলে দিতে পারে

৬. লতিফুর রহমান – ট্রান্সকম গ্রুপ (Transcom Group)

  • নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসার মেলবন্ধন

    লতিফুর রহমানের ব্যবসায়িক জীবন শুরু হয়েছিল চা বাগানের একজন ট্রেইনি হিসেবে। সেখান থেকে ধাপে ধাপে তিনি দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি হয়ে ওঠেন। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল, তিনি ছিলেন একজন সৎ এবং নৈতিক ব্যবসায়ী। যে সময়ে ব্যবসায়িক জগতে ছলচাতুরি আর দুর্নীতির ছড়াছড়ি, সেই সময়ে তিনি সততা এবং সুশাসনকে তার ব্যবসার মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

  • ট্রান্সকম গ্রুপের বৈচিত্র্যময় ব্যবসা

    ১৯৭৩ সালে তিনি ট্রান্সকম গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। তার নেতৃত্বে এই গ্রুপটি ফার্মাসিউটিক্যালস (এসকেএফ), মিডিয়া (প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার), খাদ্য ও পানীয় (পেপসি, সেভেন-আপ, কেএফসি, পিৎজা হাট) এবং ইলেকট্রনিক্স (স্যামসাং, ফিলিপস) খাতে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। তিনি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোকে বাংলাদেশে আনতে এবং তাদের মান বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে, প্রথম আলো এবং দ্য ডেইলি স্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি দেশের স্বাধীন সাংবাদিকতার পথকে সুগম করেছেন।

  • তার রেখে যাওয়া আদর্শ

    ২০২০ সালে লতিফুর রহমান মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তিনি রেখে গেছেন এক বিশাল শিল্প সাম্রাজ্যের পাশাপাশি ব্যবসায়িক সততার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, কোনো ধরনের অনৈতিক পন্থা অবলম্বন না করেও ব্যবসায় সফল হওয়া সম্ভব। তার জীবন ও কর্ম নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের জন্য সততার সঙ্গে ব্যবসা করার এক চিরন্তন অনুপ্রেরণা।

৭. আইভি হক রাসেল – মায়া (Maya)

  • প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা

    আইভি হক রাসেল একজন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিসেবে যুক্তরাজ্যে কাজ করতেন। প্রথমবার মা হওয়ার পর তিনি নিজের এবং সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শের জন্য নির্ভরযোগ্য কোনো প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বিশেষ করে, এমন অনেক ব্যক্তিগত প্রশ্ন ছিল যা তিনি সহজে কারো সাথে আলোচনা করতে পারছিলেন না। এই ব্যক্তিগত সংকট থেকেই তিনি একটি বড় ব্যবসায়িক সুযোগ দেখতে পান।

  • ‘মায়া’র চ্যালেঞ্জ ও সাফল্য

    তিনি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির স্বপ্ন দেখেন যেখানে নারীরা পরিচয় গোপন রেখে তাদের স্বাস্থ্য, মানসিক এবং আইনি সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলতে পারবেন। এই চিন্তা থেকেই ২০১৪ সালে তিনি ‘মায়া’ অ্যাপ চালু করেন। শুরুর পথটা সহজ ছিল না। বাংলাদেশের মতো একটি রক্ষণশীল সমাজে নারীদের স্বাস্থ্য ও মানসিক সমস্যা নিয়ে কথা বলাটা ছিল এক ধরনের ট্যাবু। বিনিয়োগ পাওয়া এবং একটি নারী-কেন্দ্রিক প্রযুক্তি স্টার্টআপকে সফল করা ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তিনি দমে যাননি। তার প্ল্যাটফর্মটি ধীরে ধীরে নারীদের আস্থা অর্জন করতে শুরু করে।

  • বর্তমান অবস্থান ও সামাজিক প্রভাব

    আজ ‘মায়া’ শুধু বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম জনপ্রিয় একটি ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্ল্যাটফর্ম। মিলিয়ন মানুষ, বিশেষ করে নারীরা, এর মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিচ্ছেন। গুগল, ফেসবুক এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বিনিয়োগ পেয়ে ‘মায়া’ এখন তার সেবা আরও সম্প্রসারণ করছে। আইভি হক রাসেল দেখিয়েছেন যে, নিজের জীবনের কোনো সমস্যা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েও একটি সফল এবং সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসা গড়ে তোলা সম্ভব।

৮. ওয়াসিম আলিম – চালডাল (Chaldal)

  • ই-কমার্সে এক নতুন দিগন্ত

    ওয়াসিম আলিম আমেরিকার বিখ্যাত সিলিকন ভ্যালিতে চাকরি করতেন। সেখানে তিনি প্রযুক্তি খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। কিন্তু দেশের জন্য কিছু করার তাগিদে তিনি এবং তার দুই বন্ধু জিয়া আশরাফ ও তেজাশ বিশ্বনাথ ভালো বেতনের চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তারা দেখলেন, ঢাকার মানুষের জীবন যানজটে স্থবির। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় নষ্ট হয়।

  • ‘চালডাল’-এর প্রতিষ্ঠা ও গ্রোথ হ্যাকিং

    এই সমস্যা সমাধানের জন্য ২০১৩ সালে তারা অনলাইন গ্রোসারি শপ ‘চালডাল ডট কম’ প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুর দিকে তাদের মডেল ছিল অন্যান্য দোকান থেকে পণ্য কিনে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু এতে পণ্যের মান এবং ডেলিভারির সময় নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। তাই তারা নিজেদের ওয়্যারহাউজ বা গুদামঘর তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। এই ‘ডার্ক স্টোর’ মডেলটিই তাদের সাফল্যের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে তারা নিজেরাই পণ্য মজুদ করে, মান নিয়ন্ত্রণ করে এবং এক ঘণ্টার মধ্যে গ্রাহকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।

  • বর্তমান অবস্থান ও বাজারের শীর্ষস্থান দখল

    ‘চালডাল’ আজ দেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন গ্রোসারি প্ল্যাটফর্ম। ওয়াই কম্বিনেটরের মতো বিশ্বের সেরা স্টার্টআপ অ্যাক্সিলারেটর থেকে ফান্ডিং পাওয়া প্রথম বাংলাদেশি স্টার্টআপগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। তারা এখন সবজি, ফলসহ বিভিন্ন পণ্য সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করছে, যা কৃষকদের ন্যায্যমূল্য পেতে সাহায্য করছে। ওয়াসিম আলিম প্রমাণ করেছেন যে, দেশের সাধারণ একটি সমস্যাকে প্রযুক্তির মাধ্যমে সমাধান করে একটি আন্তর্জাতিক মানের ব্যবসা দাঁড় করানো যায়।

৯. ফাইম সালেহ – পাঠাও (Pathao)

  • এক তরুণ প্রযুক্তিবিদের স্বপ্ন

    ফাইম সালেহ ছিলেন একজন প্রযুক্তি বিস্ময়। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি কোডিং এবং ওয়েব ডেভেলপমেন্টে পারদর্শী ছিলেন। হাই স্কুলে থাকতেই তিনি বিভিন্ন প্রযুক্তি-ভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে মিলিয়ন ডলার আয় করেন। নিউইয়র্কে বড় হলেও তার মন পড়ে থাকত বাংলাদেশে। তিনি সবসময় চাইতেন তার প্রযুক্তিগত জ্ঞান দিয়ে দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে।

  • ‘পাঠাও’ এবং বাংলাদেশের রাইডশেয়ারিং বিপ্লব

    ঢাকার ভয়াবহ যানজট দেখে তিনি এবং তার দুই বন্ধু হুসাইন ইলিয়াস ও সিফাত আদনান একটি যুগান্তকারী সমাধান নিয়ে আসেন। ২০১৫ সালে তারা প্রথমে একটি ই-কমার্স ডেলিভারি সার্ভিস হিসেবে ‘পাঠাও’ শুরু করেন। কিন্তু দ্রুতই তারা বুঝতে পারেন যে, ঢাকার রাস্তায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মানুষের যাতায়াত। সেই চিন্তা থেকে তারা মোটরবাইককে রাইডশেয়ারিংয়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার ধারণা নিয়ে আসেন, যা ছিল এক কথায় বৈপ্লবিক। ‘পাঠাও’ দ্রুতই তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থায় একটি বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে। পরবর্তীতে তারা ফুড ডেলিভারি এবং পার্সেল সার্ভিসে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করে।

  • তার অনুপ্রেরণামূলক 

    ২০২০ সালে নিউইয়র্কে এক মর্মান্তিক ঘটনায় ফাইম সালেহকে হত্যা করা হয়। তার অকাল মৃত্যু দেশের প্রযুক্তি জগতে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করে। কিন্তু তিনি যে পথ দেখিয়ে গেছেন, তা আজ হাজারো তরুণ উদ্যোক্তাকে অনুপ্রাণিত করে। ‘পাঠাও’ প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশি তরুণরাও বিশ্বমানের প্রযুক্তি কোম্পানি তৈরি করতে সক্ষম। ফাইম সালেহ বেঁচে না থাকলেও তার স্বপ্ন এবং কাজ চিরকাল বেঁচে থাকবে।

১০. আনিসুল হক – মোহাম্মদী গ্রুপ (Mohammadi Group)

  • উদ্যোক্তা থেকে জননেতা

    আনিসুল হক তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল ব্যবসা করার। ১৯৮৬ সালে তিনি তার নিজের তৈরি পোশাক কারখানা ‘মোহাম্মদী গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন। তার মেধা, পরিশ্রম এবং নেতৃত্বের গুণে মোহাম্মদী গ্রুপ দ্রুতই দেশের অন্যতম সেরা গার্মেন্টস রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

  • মোহাম্মদী গ্রুপের সাফল্য

    তিনি শুধু নিজের ব্যবসাতেই সফল হননি, তিনি পুরো পোশাক শিল্পকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বিজিএমইএ এবং এফবিসিসিআই-এর মতো ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনগুলোর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার সময়ে তিনি দেশের পোশাক শিল্পের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উজ্জ্বল করতে এবং শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি বিদ্যুৎ এবং আইটি খাতেও তার ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন।

  • সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে তার অবদান

    একজন সফল ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও তিনি সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা ভোলেননি। ২০১৫ সালে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। মেয়র হিসেবে তিনি অত্যন্ত অল্প সময়ে ঢাকা শহরের চেহারা বদলে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তেজগাঁওয়ের ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদ, গাবতলীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ, ঢাকাকে সবুজ ও পরিচ্ছন্ন করার জন্য তার ‘গ্রিন ঢাকা, ক্লিন ঢাকা’ अभियान জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। ২০১৭ সালে তার মৃত্যু দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি ছিল। আনিসুল হক দেখিয়েছেন যে, একজন উদ্যোক্তা কীভাবে তার মেধা ও সততা দিয়ে শুধু ব্যবসার জগতেই নয়, দেশ ও মানুষের সেবায়ও নিজেকে নিয়োজিত করতে পারেন।

নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়

উদ্যোক্তা হবেন? শূন্য থেকে সাফল্যের পথে আপনার প্রথম ধাপ

এই কিংবদন্তি উদ্যোক্তাদের জীবন থেকে আমরা কিছু অমূল্য শিক্ষা নিতে পারি, যা যেকোনো নতুন উদ্যোক্তার পথচলার পাথেয় হতে পারে।

  • সমস্যা সমাধানকে গুরুত্ব দেওয়া: প্রতিটি সফল উদ্যোগই কোনো না কোনো বাস্তব সমস্যার সমাধান করেছে। ‘পাঠাও’ ঢাকার যানজটের সমাধান করেছে, ‘বিকাশ’ আর্থিক লেনদেনকে সহজ করেছে আর ‘মায়া’ স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করেছে। তাই নতুন উদ্যোক্তাদের উচিত মুনাফার আগে মানুষের কোনো একটি নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দেওয়া।

  • ছোট থেকে শুরু করা: স্যার ফজলে হাসান আবেদ একটি ছোট ত্রাণ কার্যক্রম দিয়ে ব্র্যাক শুরু করেছিলেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস মাত্র ৮৫৬ টাকা দিয়ে তার ক্ষুদ্রঋণের যাত্রা শুরু করেন। বড় স্বপ্ন দেখুন, কিন্তু শুরুটা করুন ছোট এবং বাস্তবসম্মতভাবে।

  • ব্যর্থতাকে ভয় না পাওয়া: কোনো উদ্যোক্তার পথই মসৃণ ছিল না। তাদের প্রত্যেককেই বহুবার ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু তারা হাল ছেড়ে দেননি। ব্যর্থতা শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আবার চেষ্টা করতে হবে।

  • নেটওয়ার্কিং এবং সঠিক টিম গঠন: একা সবকিছু করা সম্ভব নয়। ফাইম সালেহ, ওয়াসিম আলিম—তারা সবাই সঠিক সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং একটি শক্তিশালী টিম গঠন করেছিলেন। সঠিক মানুষ এবং নেটওয়ার্ক আপনার যাত্রাকে অনেক সহজ করে দিতে পারে।

  • নৈতিকতা ও সততা বজায় রাখা: লতিফুর রহমানের জীবন আমাদের শেখায় যে, দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের জন্য ব্যবসায়িক সততার কোনো বিকল্প নেই। সততা এবং নৈতিকতা আপনার ব্র্যান্ডের প্রতি গ্রাহকের আস্থা তৈরি করে, যা যেকোনো ব্যবসার জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ।

উপসংহার (Conclusion)

এই ১০ জন উদ্যোক্তার গল্প শুধু কিছু ব্যক্তিগত সাফল্যের কাহিনী নয়, এটি একটি পরিবর্তনশীল বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। তারা আমাদের দেখিয়েছেন যে, প্রতিকূল পরিবেশ, সীমিত পুঁজি বা সামাজিক বাধা—কোনোকিছুই অদম্য ইচ্ছাশক্তির সামনে টিকতে পারে না। তারা শুধু ব্যবসাই তৈরি করেননি, তারা তৈরি করেছেন আশা, দিয়েছেন লাখো তরুণের স্বপ্ন দেখার সাহস। তাদের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মও পারে নতুন কিছু করতে, পারে উদ্যোক্তা হয়ে দেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে। তাদের দেখানো পথ ধরেই হয়তো একদিন এই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে উদ্যোক্তাদের এক উর্বর চারণভূমি।

আপনার চোখে বাংলাদেশের সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী উদ্যোক্তা কে? কমেন্টে আমাদের তার গল্পটি জানাতে ভুলবেন না।

ইতিহাসের সেরা ১০ উদ্যোক্তা

Leave a Comment

সম্পর্কিত পোস্টসমূহ

আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

Scroll to Top