ভূমিকা:
এক কাপ কফির উষ্ণতায় বোনা স্বপ্ন
ঢাকার অভিজাত এলাকার এক কোণে অবস্থিত “ক্যাফে অ্যাভিনিউ”-এর কাঁচের দেয়াল ঘেঁষে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সেপ্টেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে শহরের ব্যস্ততা যেন এই এক চিলতে ঠিকানায় এসে বিশ্রাম নিয়েছে। ভেতরে কফি বিন রোস্ট করার হালকা সুবাস, এসপ্রেসো মেশিনের মৃদু গুঞ্জন আর পিয়ানোর নরম সুর মিলেমিশে একাকার। ক্যাফের এক কোণায়, জানালার পাশে রাখা আরামদায়ক উইং চেয়ারে বসে আছে মিতু রহমান। তার সামনে সদ্য বানানো এক কাপ ক্যাপুচিনো, যার ধোঁয়া জানালার কাঁচের গায়ে বিন্দু বিন্দু জলকণার সাথে পাল্লা দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে।
আজকের এই মিতু রহমান শুধু একজন সফল ব্যবসায়ী নন, তিনি একটি অনুপ্রেরণার নাম। তার হাতে গড়া “ক্যাফে অ্যাভিনিউ” এখন শুধু একটি কফি শপ নয়, এটি একটি লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড, যার শাখা দেশের বড় বড় শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার চেহারায় সাফল্যের ঔজ্জ্বল্যের চেয়েও বেশি ফুটে উঠেছে এক ধরনের প্রশান্তি, এক ধরনের স্মৃতি রোমন্থনের আবেশ। বাইরে ঝরতে থাকা বৃষ্টি তাকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অতীতের সেই দিনগুলোতে, যখন এই স্বপ্নটি ছিল শুধু তার একান্ত নিজের—একদম কাঁচা, অনিশ্চিত, কিন্তু আবেগে ভরপুর।
অনেকেই তার এই যাত্রার চূড়ান্ত সাফল্যটুকুই দেখে। তারা দেখে একটি সফল ব্র্যান্ড, একজন আত্মবিশ্বাসী নারী উদ্যোক্তা। কিন্তু তারা জানে না এর পেছনের গল্পটা—মধ্যবিত্ত জীবনের সীমাবদ্ধতা, পারিবারিক প্রত্যাশার চাপ, কর্পোরেট জগতের শূন্যতা আর একাকী সংগ্রামের সেই রাতগুলো। তারা জানে না, কীভাবে মায়ের রান্নাঘরের উষ্ণতা আর মানুষের সঙ্গ লাভের এক অদম্য ইচ্ছা তাকে এই পথে নিয়ে এসেছিল।
মিতু কফির কাপে আলতো করে চুমুক দেয়। কফির তিক্ত-মিষ্টি স্বাদটা তাকে মনে করিয়ে দেয় তার ফেলে আসা পথের কথা—যেখানে ব্যর্থতার তিক্ততা ছিল, আবার ছিল ছোট ছোট সাফল্যের অনাবিল আনন্দ। এই ক্যাফেটি তার কাছে নিছক একটি ব্যবসা নয়, এটি তার শৈশবের স্মৃতির বাস্তব রূপ, তার হারিয়ে যাওয়া সংযোগ খুঁজে পাওয়ার ঠিকানা। কাঁচের দেয়ালে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেমন একে অপরের সাথে মিশে একটি জলধারা তৈরি করছে, মিতুর স্বপ্নও তেমনি অসংখ্য মানুষের গল্প, আড্ডা আর মুহূর্তকে এক সুতোয় গেঁথে চলেছে। এই গল্প সেই স্বপ্ন বোনার গল্প, এক কাপ কফির উষ্ণতাকে পুঁজি করে একটি শহরকে নিজের ঠিকানা বানিয়ে নেওয়ার গল্প।
প্রথম অধ্যায়
শৈশব ও বেড়ে ওঠার দিনগুলি
মিতুর গল্পের শুরুটা ঢাকার আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই সাদামাটা, কিন্তু অনুভূতির দিক থেকে ছিল ভীষণ রঙিন। তার বাবা, জনাব বশীর আহমেদ, ছিলেন একজন সৎ এবং রাশভারী সরকারি কর্মকর্তা। নিয়ম আর শৃঙ্খলাই ছিল তার জীবনের মূলমন্ত্র। অন্যদিকে তার মা, মিসেস আমিনা বেগম, ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষিকা এবং সংসার নামক রাজ্যের এক নিপুণ কারিগর। এই দুই বিপরীত ব্যক্তিত্বের ছায়াতলে মিতুর বেড়ে ওঠা। বাবার কাছ থেকে সে পেয়েছিল নিয়মানুবর্তিতা আর কাজের প্রতি নিষ্ঠার শিক্ষা, আর মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিল মানুষ ভালোবাসার এক অমূল্য গুণ।
তাদের তিন বেডরুমের সরকারি কোয়ার্টারটি আকারে বড় না হলেও, সব সময় মানুষে গমগম করত। আমিনা বেগমের হাতের রান্না আর তার আন্তরিক আতিথেয়তার সুখ্যাতি ছিল আত্মীয়-পরিজন আর পাড়া-প্রতিবেশীদের মুখে মুখে। ছুটির দিনগুলোতে বা যেকোনো উৎসব-পার্বণে তাদের বাড়িটা যেন এক মিলনমেলায় পরিণত হতো। ড্রয়িংরুমে চলত বড়দের গুরুগম্ভীর আলোচনা, আর বারান্দায় বা ছাদে চলত ছোটদের হুল্লোড়। এই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতেন মিতুর মা। তিনি নিপুণ হাতে সবটা সামলাতেন—রান্নাঘর থেকে অতিথিদের প্লেটে গরম লুচি তুলে দেওয়া, চায়ের কাপে চুমুকের সাথে সাথে তাদের সুখ-দুঃখের গল্প শোনা—সবকিছুতেই ছিল তার এক শৈল্পিক ছোঁয়া।
মিতু ছোটবেলা থেকেই ছিল খুব observant। মায়ের পাশে ঘুরঘুর করতে করতে সে দেখত, কীভাবে এক কাপ চা বা এক বাটি পায়েস মানুষের মধ্যকার জড়তা নিমেষে কাটিয়ে দেয়। সে দেখত, কীভাবে তার মা শুধু খাবার পরিবেশন করছেন না, বরং ভালোবাসার অদৃশ্য সুতো দিয়ে মানুষগুলোকে একে অপরের সাথে বেঁধে দিচ্ছেন। শীতের সন্ধ্যায় যখন গরম ভাপা পিঠার সাথে গুড়ের মিষ্টি গন্ধ সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ত, তখন মিতু দেখত বাবার রাশভারী সহকর্মীরাও সহজ-সরল আড্ডায় মেতে উঠতেন। এই দৃশ্যগুলো তার কচি মনে গভীরভাবে ছাপ ফেলেছিল। সে অবচেতনভাবেই শিখছিল যে, খাবার বা পানীয় শুধু ক্ষুধা বা তৃষ্ণা মেটানোর উপকরণ নয়, এগুলো আসলে সামাজিক সংযোগের অনুঘটক।
তার নিজের জগতেও এর প্রতিফলন ঘটত। সে তার খেলার সাথীদের নিয়ে আয়োজন করত ‘চা-পার্টি’। মাটির কাপে লাল রঙের জল ‘চা’ হিসেবে পরিবেশন করা হতো আর গাছের পাতা হতো ‘বিস্কুট’। কিন্তু আসল আকর্ষণ থাকত গল্প বলা। মিতু তার বন্ধুদের কাল্পনিক রাজ্যে নিয়ে যেত, যেখানে চা খেতে খেতে রাজ্যের দুঃখ দূর হয়ে যেত। তার এই অদ্ভুত খেলা দেখে তার মা হাসতেন, কিন্তু তাকে কখনও বারণ করতেন না। তিনি হয়তো বুঝতে পারতেন, তার মেয়ের মধ্যে এক অন্যরকম সত্তা বেড়ে উঠছে, যে মানুষ এবং তাদের গল্পকে ভালোবাসে।
বাবার প্রভাব ছিল অন্যরকম। তিনি মিতুকে শিখিয়েছিলেন স্বপ্ন দেখতে, তবে সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম এবং সুস্পষ্ট পরিকল্পনার। প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে বাবা তাকে বিশ্বের বড় বড় মানুষের জীবনী পড়ে শোনাতেন। মিতু শুনত কীভাবে সাধারণ অবস্থা থেকে উঠে এসে একেকজন অসাধারণ হয়ে উঠেছেন। বাবা বলতেন, “সাফল্যের কোনো শর্টকাট নেই, মা। সততা আর পরিশ্রমই একমাত্র পথ।” এই কথাগুলো মিতুর মনে গেঁথে গিয়েছিল। তাই মায়ের কাছ থেকে পাওয়া আবেগ আর বাবার কাছ থেকে পাওয়া যুক্তিবোধ—এই দুইয়ের এক দারুণ মিশ্রণ ঘটেছিল তার চরিত্রে। সে একদিকে যেমন ছিল স্বপ্নচারী, সৃজনশীল, তেমনই ছিল বাস্তববাদী এবং গোছানো। তার পড়ার টেবিল, বইয়ের তাক, সবকিছু থাকত পরিপাটি, যা ছিল তার বাবার শৃঙ্খলারই প্রতিচ্ছবি।
এভাবেই শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলো কেটে যায়। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে সে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি থেকে মার্কেটিং-এ বিবিএ এবং এমবিএ সম্পন্ন করে। তার একাডেমিক ফলাফল ছিল ঈর্ষণীয়। সবাই ধরেই নিয়েছিল, মিতু কোনো বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে যোগ দিয়ে কর্পোরেট জগতের শীর্ষে পৌঁছাবে। মিতু নিজেও হয়তো তখন সেটাই ভাবত। কিন্তু সে জানত না, তার অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকা মায়ের রান্নাঘরের সেই উষ্ণতা আর মানুষের কোলাহল একদিন তাকে এক অন্য পথে চালিত করবে।
দ্বিতীয় অধ্যায়
কর্পোরেট জীবনের শূন্যতা ও নতুন পথের দিশা
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে মিতু যখন একটি নামকরা বহুজাতিক কোম্পানিতে ব্র্যান্ড ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিল, তখন তার পরিবার ও বন্ধুরা ভীষণ খুশি হয়েছিল। আকর্ষণীয় বেতন, ঝাঁ-চকচকে অফিস, সামাজিক প্রতিপত্তি—সাফল্যের সংজ্ঞায় যা যা থাকা দরকার, তার প্রায় সবকিছুই ছিল সেই চাকরিতে। প্রথম প্রথম মিতুরও বেশ ভালো লাগছিল। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ, প্রেজেন্টেশন, ব্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা—সবকিছুতেই সে তার মেধা আর পরিশ্রমের ছাপ রাখছিল। খুব অল্প সময়েই সে ম্যানেজমেন্টের নজরে চলে আসে।
কিন্তু মাস গড়িয়ে বছর পেরোতেই সেই প্রাথমিক উত্তেজনা ফিকে হতে শুরু করে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দামি পোশাক পরে কাঁচঘেরা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে যাওয়া, একের পর এক মিটিং, ডেডলাইনের চাপ আর মাস শেষে মোটা অংকের বেতন—এই চক্রের মধ্যে মিতু নিজেকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। তার মনে হতে লাগল, সে যেন এক বিশাল যন্ত্রের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, যার কাজ শুধু যন্ত্রটাকে সচল রাখতে সাহায্য করা। তার সৃজনশীলতাকে ব্যবহার করা হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু তা ছিল অন্যের স্বপ্ন পূরণের জন্য, অন্যের ব্র্যান্ডকে বড় করার জন্য। যে পণ্যটি সে বিক্রি করছে, তার সাথে তার কোনো আত্মিক সংযোগ ছিল না।
বিশেষ করে তার নিঃসঙ্গতা বাড়ছিল। অফিসে সবার সাথে তার পেশাগত সম্পর্ক ছিল, কিন্তু দিনের শেষে মনের কথা বলার মতো কেউ ছিল না। লাঞ্চের সময় বা কফি ব্রেকে যেটুকু আড্ডা হতো, তার পুরোটাই থাকত অফিস পলিটিক্স বা প্রমোশনের আলোচনায় সীমাবদ্ধ। এই কর্পোরেট জগৎটাকে তার কাছে বড্ড যান্ত্রিক আর আবেগহীন মনে হতো।
এই একঘেয়েমি আর মানসিক ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে সে আশ্রয় নিত শহরের বিভিন্ন কফি শপে। অফিসের পর বা ছুটির দিনে সে ল্যাপটিপ আর একটা বই নিয়ে কোনো না কোনো কফি শপে গিয়ে বসত। এটা ছিল তার পালানোর একটা পথ, নিজের সাথে কথা বলার একটা সুযোগ। সে ঢাকার প্রায় সব নামকরা কফি শপেই ঘুরেছে। কোনোটা ছিল তরুণদের আড্ডায় মুখর, কোনোটা ছিল ভীষণ ফর্মাল আর শান্ত, আবার কোনোটা ছিল বিদেশি চেইনের ঝকঝকে আউটলেট।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সে চারপাশের মানুষগুলোকে দেখত। সে লক্ষ্য করত, এই জায়গাগুলোতে মানুষ আসে ঠিকই, কিন্তু তারা যেন প্রত্যেকে এক-একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। প্রায় সবাই হয় ল্যাপটপে ব্যস্ত, নয়তো মোবাইলের স্ক্রিনে বুঁদ হয়ে আছে। টেবিলে চারজন বন্ধু একসাথে বসে থাকলেও তাদের মধ্যে কথার চেয়ে মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটিই বেশি চলে। কফি শপগুলো যেন হয়ে উঠেছিল কাজ করার বা একাকী সময় কাটানোর একটা বিকল্প জায়গা। এখানকার পরিবেশটা কার্যকরী, কিন্তু উষ্ণতাহীন। এখানকার কফি হয়তো আন্তর্জাতিক মানের, কিন্তু তাতে কোনো প্রাণের ছোঁয়া নেই।
এই উপলব্ধিগুলো তার মনে জমতে থাকে। একদিন সন্ধ্যায়, এক টানা বৃষ্টির পর, সে গুলশানের একটি বিখ্যাত কফি চেইনের আউটলেটে বসে ছিল। তার সামনে ছিল একটি দামী কিন্তু নিতান্তই সাধারণ স্বাদের ক্যাপুচিনো। বাইরে তখন ভেজা শহরের নিয়ন আলো জ্বলছে-নিভছে। হঠাৎ করেই তার শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল। তার মনে পড়ল, তাদের বাড়িতে বৃষ্টির দিনে কীভাবে গরম গরম পেঁয়াজু আর চায়ের আসর বসত। মাটির কাপে ধোঁয়া ওঠা চা, সাথে প্রতিবেশীদের নির্মল হাসি আর আড্ডা—সেই মুহূর্তগুলোর উষ্ণতার কাছে এই কফি শপের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আরাম তার কাছে তুচ্ছ মনে হলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে তার মাথায় যেন বিদ্যুতের ঝলকানি খেলে গেল। সে তার সামনে রাখা টিস্যু পেপারের ওপর আনমনে লিখতে শুরু করল। আচ্ছা, এমন একটা জায়গা কি তৈরি করা যায় না, যা শুধু কফি বিক্রি করবে না, বরং মানুষের মধ্যে সংযোগ তৈরি করবে? এমন একটা জায়গা, যেখানে মানুষ ল্যাপটপ বা মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে একে অপরের সাথে কথা বলবে, হাসবে, নতুন বন্ধুত্ব তৈরি করবে? যেখানে কফির গন্ধের সাথে মিশে থাকবে বইয়ের গন্ধ, লাইভ মিউজিকের সুর আর মানুষের উষ্ণতা?
তার মনে হলো, এই যান্ত্রিক শহরে এমন একটা জায়গার ভীষণ প্রয়োজন, যেখানে মানুষ একটু জিরিয়ে নিতে পারবে, নিজের মতো করে সময় কাটাতে পারবে, কিন্তু একা অনুভব করবে না। সে এমন একটি কফি শপ তৈরির স্বপ্ন দেখল, যা হবে শহরের বুকে এক টুকরো বাড়ির মতো। যার একটা নিজস্ব গল্প থাকবে, একটা আত্মা থাকবে।
টিস্যু পেপারের এক কোণায় সে কাঁপা কাঁপা হাতে লিখল—”ক্যাফে অ্যাভিনিউ”। আর তার নিচে লিখল ট্যাগলাইন—”আপনার শহরের ঠিকানা”।
সেই সন্ধ্যায়, সেই কফি শপে বসে মিতু রহমান তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলে। সে ঠিক করে, অন্যের ব্র্যান্ডকে বড় করার জন্য আর নয়, এবার সে নিজের একটি স্বপ্নকে বাঁচিয়ে তুলবে। যে স্বপ্ন শুধু তার একার নয়, বরং এই শহরের হাজারো নিঃসঙ্গ মানুষের জন্য একটি উষ্ণ ঠিকানা খুঁজে দেওয়ার স্বপ্ন। ঝুঁকি আছে, অনিশ্চয়তা আছে, কিন্তু প্রথমবারের মতো সে তার জীবনের একটি সত্যিকারের উদ্দেশ্য খুঁজে পায়। তার কর্পোরেট জীবনের শূন্য ক্যানভাসে সে যেন এক নতুন স্বপ্নের প্রথম আঁচড় কাটে।
তৃতীয় অধ্যায়
স্বপ্নের পথে প্রথম বাধা
স্বপ্ন দেখা যতটা সহজ, তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথটা ততটাই কঠিন। মিতু খুব তাড়াতাড়িই এই সত্যের মুখোমুখি হলো। তার প্রথম এবং সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি এলো নিজের পরিবার থেকেই।
একদিন রাতে খাওয়ার টেবিলে সে তার সিদ্ধান্তের কথা জানায়—সে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে নিজের একটা কফি শপ খুলতে চায়। কথাটা শোনার পর কয়েক মুহূর্তের জন্য গোটা ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তার বাবা, বশীর সাহেব, খাওয়া থামিয়ে চশমার ওপর দিয়ে মেয়ের দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন তিনি ঠিকমতো শুনতে পাননি। মিতুর মা আমিনা বেগমের মুখে ফুটে উঠল উদ্বেগের ছায়া।
বশীর সাহেব তার গম্ভীর গলায় বললেন, “মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? এত ভালো একটা চাকরি, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, সব ছেড়ে দিয়ে তুমি দোকানদারি করবে? কফি শপের ব্যবসা কি আজকাল যে কেউ চাইলেই করতে পারে? কত রিস্ক আছে জানো?”
মিতু শান্তভাবে বোঝানোর চেষ্টা করল, “বাবা, এটা শুধু একটা দোকান হবে না। আমার একটা অন্যরকম পরিকল্পনা আছে।”
“কী পরিকল্পনা? সব উড়নচণ্ডী পরিকল্পনা,”—বাবার গলায় ছিল স্পষ্ট বিরক্তি। “যে পথে সবাই সফল হয়, সে পথে না হেঁটে সবসময় একটা নতুন কিছু করার ভূত চাপে তোমার মাথায়। একটা মেয়ের জন্য এত ঝুঁকি নেওয়ার কোনো দরকার নেই। चुपचाप চাকরিটা করো।”
বাবার সাথে সেই রাতের কথোপকথন মিতুর মনে একটা গভীর ক্ষত তৈরি করে। যে বাবা তাকে বড় বড় মানুষের জীবনী শুনিয়ে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন, তিনিই আজ তার স্বপ্নের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। তবে মায়ের প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন। তিনি ভয় পেলেও মেয়ের চোখের স্বপ্নটাকে দেখতে পাচ্ছিলেন। রাতে তিনি মিতুর ঘরে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু বলেছিলেন, “যা-ই করিস, ভেবেচিন্তে করিস। আমি তোর পাশে আছি।” মায়ের এইটুকু কথাই মিতুর জন্য ছিল অনেক বড় শক্তি।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল আর্থিক। তার জমানো টাকা একটা কফি শপ শুরু করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাকে ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হলো লোনের জন্য। কিন্তু একজন তরুণী, যার ব্যবসায়িক কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, তাকে লোন দিতে কোনো ব্যাংকই সহজে রাজি হচ্ছিল না। তার বিজনেস প্ল্যান দেখে ব্যাংক কর্মকর্তারা এমন সব প্রশ্ন করছিলেন, যেন তারা প্রমাণ করতে চাইছেন যে এই ব্যবসা চলতেই পারে না। দিনের পর দিন বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে মিতু প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত, মায়ের দেওয়া কিছু গয়না বিক্রি করে এবং এক দূর সম্পর্কের মামার সুপারিশে একটি ছোট ব্যাংক থেকে সামান্য কিছু লোন পায়। কিন্তু সেই টাকার পরিমাণ তার পরিকল্পনার চেয়ে অনেক কম ছিল।
এরপর শুরু হয় তৃতীয় চ্যালেঞ্জ—সঠিক জায়গার সন্ধান। তার স্বপ্ন ছিল এমন একটি জায়গায় ক্যাফেটি হবে, যেখানে কোলাহল আছে কিন্তু অস্থিরতা নেই। যেখানে তরুণরা সহজে আসতে পারবে। কিন্তু ঢাকার মতো শহরে এমন জায়গা পাওয়া, যা তার বাজেটের মধ্যে হবে, ছিল প্রায় অসম্ভব। দিনের পর দিন সে ধানমন্ডি, বনানী, মোহাম্মদপুরের অলিগলিতে হেঁটে বেড়িয়েছে। কত রিয়েল এস্টেট এজেন্টের অদ্ভুত অদ্ভুত কথা তাকে শুনতে হয়েছে। কেউ তাকে এমন এক অন্ধকার গলি দেখিয়েছে যেখানে ক্যাফের বদলে ভূতের বাড়ি বানানোই যুক্তিযুক্ত, আবার কেউ এমন ভাড়া চেয়েছে যা দিয়ে আস্ত একটা বাড়ি কেনা যায়। এই লড়াইটা ছিল একাকী এবং ভীষণ ক্লান্তিকর।
এই প্রাথমিক চ্যালেঞ্জগুলো মিতুকে শিখিয়েছিল, উদ্যোক্তা হওয়ার পথটা ফুলে বিছানো নয়। এখানে প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াই করতে হয়, নিজের সাথে, পরিস্থিতির সাথে এবং কখনও কখনও প্রিয়জনদের সাথেও।
চতুর্থ অধ্যায়
স্বপ্নের প্রথম ইট
অনেক খোঁজাখুঁজির পর, অবশেষে ধানমন্ডির এক নিরিবিলি লেকের পাশে, পুরনো একটি দোতলা বাড়ির নিচতলায় relativamente কম ভাড়ায় একটি জায়গা পাওয়া গেল। জায়গাটা ছিল স্যাঁতসেঁতে, পুরানো, কিন্তু মিতুর চোখে ভাসছিল তার স্বপ্নের “ক্যাফে অ্যাভিনিউ”-এর ছবি। সে তার সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে জায়গাটার অগ্রিম ভাড়া পরিশোধ করে।
এরপরের ধাপ ছিল চাকরি ছাড়া। অফিসে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার দিন তার বস অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। সহকর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে “সাহসী” বলেছিল, আবার কেউ আড়ালে বলেছিল “বোকা”। কিন্তু মিতুর মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। সে জানত, সে তার জীবনের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিচ্ছে।
এরপর শুরু হলো আসল যুদ্ধ। কম বাজেটের কারণে ইন্টেরিয়র ডিজাইনার রাখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মিতু নিজেই ডিজাইনার, নিজেই প্রজেক্ট ম্যানেজার। সে ইন্টারনেট ঘেঁটে, বিভিন্ন ম্যাগাজিন দেখে একটা ডিজাইন প্ল্যান তৈরি করল। পুরনো বাড়িটার দেয়ালের প্লাস্টার তুলে ফেলে ইটের দেয়ালটাকে সে 그대로 রেখে দিল। তাতে এক ধরনের দেহাতি কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়া এলো। নীলক্ষেত আর পুরান ঢাকার দোকান থেকে淘淘 করে সে সস্তায় সেকেন্ড হ্যান্ড চেয়ার-টেবিল কিনল। তারপর ছুটির দিনে কয়েকজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে সেগুলোকে ঘষেমেজে, নতুন করে রঙ করে ক্যাফের জন্য প্রস্তুত করল। ক্যাফের এক কোণায় একটি বুকশেলফ বানানোর জন্য সে কাঠমিস্ত্রিদের সাথে দিনের পর দিন কাজ করেছে। এমনকি ক্যাফের দেয়ালে আঁকা ছবিগুলোও ছিল তারই এক চিত্রকর বন্ধুর আঁকা।
কফি বিন সংগ্রহের জন্য সে ছুটে গেল পার্বত্য চট্টগ্রামে। সেখানে স্থানীয় চাষিদের সাথে কথা বলে, তাদের জীবনযাত্রা দেখে সে মুগ্ধ হলো। সে সিদ্ধান্ত নিল, তার ক্যাফেতে বিদেশি বিনের বদলে দেশের সেরা অর্গানিক কফি বিন ব্যবহার করবে। এতে দেশের চাষিরাও লাভবান হবে।
সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল কর্মী নিয়োগ। সে এমন কর্মী খুঁজছিল, যারা শুধু কফি বানাতে জানবে না, বরং মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলতে পারবে, গ্রাহকদের একটি সুন্দর অভিজ্ঞতা দিতে পারবে। অনেক খুঁজে সে দুজন তরুণকে নিয়োগ দিল—সজীব, যে একটি নামকরা কফি শপে কাজ করত, এবং প্রিয়া, যে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী। মিতু তাদের নিজে প্রশিক্ষণ দিল। সে তাদের শেখাল, “আমাদের কাজ শুধু কফি বিক্রি করা নয়, আমাদের কাজ হলো মানুষের দিনটাকে একটু সুন্দর করে তোলা।”
অবশেষে সেই দিন এলো। কোনো জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধন নয়, শুধু কাছের কিছু বন্ধু আর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে “ক্যাফে অ্যাভিনিউ”-এর যাত্রা শুরু হলো। তার বাবা সেদিন আসেননি, কিন্তু মা এসেছিলেন একরাশ দোয়া নিয়ে। ক্যাফের দরজায় সবুজ লতাপাতা দিয়ে সাজানো কাঠের সাইনবোর্ডে লেখা নামটি দেখে মিতুর চোখে জল এসে গিয়েছিল। তার স্বপ্নের প্রথম ইটটি আজ গাঁথা হলো।
পঞ্চম অধ্যায়
সংগ্রাম, ব্যর্থতা এবং এক পশলা বৃষ্টি
স্বপ্নেরা যখন বাস্তবে রূপ নেয়, তখন তার সাথে কঠিন বাস্তবতাও জড়িয়ে থাকে। “ক্যাফে অ্যাভিনিউ” খোলার প্রথম কয়েক মাস মিতুর জন্য ছিল এক অগ্নিপরীক্ষা। দিনের বেশিরভাগ সময় ক্যাফে প্রায় ফাঁকাই থাকত। দু-একজন কাস্টমার এলেও তারা বেশিক্ষণ বসত না। প্রতিদিনের খরচ, কর্মীদের বেতন, দোকান ভাড়া—সবকিছু মেটাতে গিয়ে তার জমানো টাকা দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল।
রাতের পর রাত তার ঘুম হতো না। সারাদিন ক্যাফেতে হাড়ভাঙা খাটুনির পর বাড়ি ফিরে সে হিসাবের খাতা নিয়ে বসত। প্রতিদিনের লোকসান দেখতে দেখতে তার আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। তার মনে হতো, বাবা হয়তো ঠিকই বলেছিলেন। সে হয়তো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। একাকীত্বের এই দিনগুলোতে সে কাউকে তার কষ্টের কথা বলতে পারত না। বন্ধুদের সামনে তাকে হাসিখুশি থাকতে হতো, প্রমাণ করতে হতো যে সে ঠিক আছে।
এর মধ্যে একদিন ঘটল সেই ভয়ংকর ঘটনা। তখন বর্ষাকাল। সারাদিন ধরে মুষলধারে বৃষ্টির পর সন্ধ্যায় হঠাৎ করে ক্যাফের সামনের রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেল। নর্দমার নোংরা পানি হু হু করে ক্যাফের ভেতরে ঢুকতে শুরু করল। মিতু আর তার দুই কর্মী মিলে আপ্রাণ চেষ্টা করেও পানি আটকাতে পারল না। দেখতে দেখতে তার সযত্নে সাজানো ক্যাফের মেঝে নোংরা পানিতে ডুবে গেল। তার অনেক কষ্টে বানানো কাঠের আসবাবপত্র, বইয়ের তাকের নিচের দিকের বই—সবকিছু ভিজে নষ্ট হয়ে গেল।
সেই রাতে, বিধ্বস্ত ক্যাফের এক কোণায় দাঁড়িয়ে মিতুর কান্না যেন থামছিলই না। তার মনে হচ্ছিল, প্রকৃতিও যেন তার স্বপ্নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তার সব আশা, সব শক্তি যেন ওই নোংরা পানির স্রোতে ভেসে গিয়েছিল। সে তার মাকে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, “মা, আমি আর পারছি না। আমি সব বন্ধ করে দেব।”
ষষ্ঠ অধ্যায়
ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
ফোনের ওপাশ থেকে তার মা শান্ত গলায় বলেছিলেন, “একবার হেরে গেলেই সব শেষ হয়ে যায় না। কাল সকালে আমি আসছি। আমরা একসাথে সব পরিষ্কার করব।”
পরদিন সকালে তার মা সত্যি সত্যি চলে এলেন। শুধু তিনি নন, সাথে করে নিয়ে এলেন মিতুর কলেজের কয়েকজন পুরোনো বন্ধুকে। তারা সবাই মিলে হাত লাগিয়ে ক্যাফে পরিষ্কার করা শুরু করল। তাদের এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখে মিতু নতুন করে শক্তি পেল। সে বুঝতে পারল, সে একা নয়।
এই ঘটনার পর মিতু নতুন করে ভাবতে শুরু করল। সে বুঝতে পারল, শুধু ভালো কফি আর সুন্দর পরিবেশ দিয়ে মানুষকে আকর্ষণ করা যাবে না। তাকে এমন কিছু করতে হবে, যা অন্য কেউ করছে না। তাকে তার ক্যাফের সেই ‘আত্মা’-টিকে জাগিয়ে তুলতে হবে।
তখনই তার মাথায় কমিউনিটি তৈরির ধারণাটি নতুন করে এলো। সে ফেসবুকের মাধ্যমে ঘোষণা দিল, প্রতি বৃহস্পতিবার “ক্যাফে অ্যাভিনিউ”-তে হবে ‘ওপেন মাইক নাইট’। যে কেউ এসে কবিতা, গল্প বা গান শোনাতে পারবে। প্রথম দিন দর্শক ছিল মাত্র জনা দশেক। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের স্বরচিত কবিতা পাঠের একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। এরপরের সপ্তাহ থেকে ওপেন মাইক নাইটে ভিড় বাড়তে শুরু করে।
এরপর সে শুরু করল ‘অ্যাকোস্টিক স্যাটারডে’, যেখানে শহরের غير معروف কিন্তু প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পীরা এসে গান শোনাত। বইপ্রেমীদের জন্য আয়োজন করল ‘বুক ক্লাব’। স্থানীয় লেখকদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের জন্য সে বিনামূল্যে তার ক্যাফে ব্যবহার করতে দিল।
ধীরে ধীরে “ক্যাফে অ্যাভিনিউ” শুধু একটি কফি শপ রইল না, এটি হয়ে উঠল শহরের সৃজনশীল মানুষদের এক মিলনকেন্দ্র। মানুষ अब सिर्फ কফি খেতে আসত না, তারা আসত একটা অভিজ্ঞতা নিতে, নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হতে, নিজেদের প্রতিভা তুলে ধরতে। মুখে মুখে ক্যাফের নাম ছড়িয়ে পড়তে লাগল। একদিন সন্ধ্যায় মিতু দেখল, তার ক্যাফের প্রতিটি টেবিল পূর্ণ, বাইরেও কিছু মানুষ অপেক্ষা করছে। সেই মুহূর্তে তার সব কষ্ট সার্থক মনে হলো।
সপ্তম অধ্যায়
সাফল্যের বিস্তার
প্রথম বছরের মাথায় “ক্যাফে অ্যাভিনিউ” শহরের অন্যতম জনপ্রিয় একটি স্থানে পরিণত হলো। বিভিন্ন পত্রিকা ও ব্লগে তাকে নিয়ে লেখালেখি শুরু হলো। ‘তরুণ নারী উদ্যোক্তা’ হিসেবে সে পরিচিতি পেতে শুরু করল। যে বাবা একদিন তার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন, তিনি একদিন चुपचाप ক্যাফেতে এসে এক কোণায় বসে কফি খেয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে মেয়ের মাথায় হাত রেখে শুধু বললেন, “আমি গর্বিত।”
সাফল্যের এই জোয়ারে গা ভাসিয়ে মিতু তার দ্বিতীয় শাখা খুলল বনানীতে, যা ছিল কর্পোরেট গ্রাহকদের কেন্দ্র করে। এরপর উত্তরায় তৃতীয় শাখা, যা ছিল মূলত পরিবার ও তরুণদের জন্য। প্রতিটি শাখার ইন্টেরিয়র এবং মেন্যুতে স্থানীয় পরিবেশের ছোঁয়া থাকলেও, মূল দর্শন—অর্থাৎ ‘কানেকশন’ তৈরি করা—অপরিবর্তিত ছিল।
যখন চট্টগ্রাম, সিলেট, এমনকি বগুড়ার মতো শহর থেকেও বিনিয়োগকারীরা “ক্যাফে অ্যাভিনিউ”-এর শাখা খোলার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতে শুরু করল, তখন মিতু বুঝতে পারল, এবার ব্র্যান্ডটিকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। সে একা হাতে সবকিছু সামলাতে পারবে না। তাই সে একটি শক্তিশালী কোর টিম তৈরি করল এবং একটি সুসংগঠিত ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেল দাঁড় করাল। সে এমন মানুষদেরই ফ্র্যাঞ্চাইজি পার্টনার হিসেবে বেছে নিল, যারা শুধু অর্থ বিনিয়োগ করতে নয়, বরং “ক্যাফে অ্যাভিনিউ”-এর আবেগ এবং দর্শনকে ধারণ করতে প্রস্তুত ছিল।
এভাবে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে মিতুর ছোট্ট একটি স্বপ্ন превратился হলো দেশের অন্যতম সফল একটি কফি চেইনে। সে এখন আর শুধু একজন ক্যাফের মালিক নয়, সে একজন সিইও, একজন লিডার, এবং শত শত কর্মীর অনুপ্রেরণা।
উপসংহার
যেখানে গল্পের শুরু
গল্পটা আবার ফিরে আসে সেই বৃষ্টি ভেজা বিকেলে। “ক্যাফে অ্যাভিনিউ”-এর সেই প্রথম শাখায়। মিতুর হাতের কফিটা এখন ঠান্ডা হয়ে গেছে। বৃষ্টিও থেমে এসেছে। জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে সে দেখছে, বিকেলের নরম আলোয় ভেজা রাস্তাটা চিকচিক করছে।
ক্যাফের ভেতরে এখন আর সকালের সেই শান্ত পরিবেশটা নেই। প্রতিটি টেবিল এখন মানুষে পূর্ণ। একদল তরুণ গিটার হাতে নতুন কোনো গানের সুরে ডুবে আছে, এক কোণায় একজন চিত্রকর মন দিয়ে স্কেচবুকে ছবি আঁকছেন, আবার জানালার পাশের টেবিলে বসে দুজন বয়স্ক মানুষ চায়ের কাপে ঝড় তুলেছেন কোনো পুরোনো স্মৃতি নিয়ে। এই কোলাহল, এই প্রাণের স্পন্দনই ছিল তার স্বপ্ন।
হঠাৎ তার চোখ পড়ল দরজার কাছে বসা এক তরুণীর দিকে। মেয়েটি একটি টিস্যু পেপারের ওপর গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছে। তার চোখেমুখে ঠিক তেমনই এক স্বপ্নালু আবেশ, যা হয়তো একদিন মিতুর চোখেও ছিল। মিতুর ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠল।
সে বুঝতে পারল, তার আসল সাফল্য এই ১০টি বা ২০টি শাখা নয়। তার আসল সাফল্য হলো এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা, যা নতুন নতুন স্বপ্নকে উৎসাহিত করে। “ক্যাফে অ্যাভিনিউ” আজ শুধু একটি ব্র্যান্ড নয়, এটি একটি প্ল্যাটফর্ম, একটি কমিউনিটি। এটি এমন একটি ঠিকানা, যেখানে প্রতিটি কাপ কফির সাথে একটি নতুন গল্প শুরু হওয়ার সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে।
মিতু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ক্যাফের মৃদু আলো-আঁধারিতে হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে সে প্রতিটি মুখের দিকে তাকায়। প্রতিটি মুখে সে খুঁজে পায় একেকটা গল্প, একেকটা স্বপ্ন। আর সে জানে, এই গল্পগুলো যতদিন থাকবে, ততদিন তার “ক্যাফে অ্যাভিনিউ”-এর আলোও কখনও নিভবে না। কারণ এটি শুধু ইট-পাথরের একটি কফি শপ নয়, এটি মানুষের ভালোবাসায় বোনা এক জীবন্ত স্বপ্ন।