স্টিভ জবস: যে জাদুকর প্রযুক্তি বিশ্বকে বদলে দিয়েছেন
ভূমিকা (Introduction)
একবার ভাবুন তো, আপনার পকেটে থাকা স্মার্টফোনটি, ডেস্কে রাখা ল্যাপটপটি, অথবা প্লে-লিস্টে বাজতে থাকা প্রিয় গানটি—এই সবকিছুই কতটা ভিন্ন হতে পারত? আজকের ডিজিটাল পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি কোণায় মিশে আছে একজনের নাম, একজনের দর্শন, একজনের সৃষ্টিশীলতার ছোঁয়া। তিনি স্টিভ জবস। তিনি কেবল অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা বা একজন সফল CEO ছিলেন না; তিনি ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, একজন শিল্পী, একজন বিপ্লবী, যিনি নীরস প্রযুক্তিকে মানুষের আবেগের সাথে জুড়ে দিয়েছিলেন। তিনি শিখিয়েছেন, একটি পণ্য শুধু যন্ত্র নয়, এটি হতে পারে শিল্পের এক অনবদ্য নিদর্শন।
এই ব্লগে আমরা কোনো সাধারণ ব্যবসায়ীর সাফল্যের গল্প বলব না। আমরা জানব সেই মানুষটির কাহিনী, যিনি নিজের বাড়ির গ্যারেজ থেকে যাত্রা শুরু করে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানি তৈরি করেছিলেন। আমরা ডুব দেব তার জীবনের উত্থান, পতন এবং ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠার এক অবিশ্বাস্য মহাকাব্যে। যে মানুষটি নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত হয়েও হার মানেননি, বরং নতুন পরিচয়ে ফিরে এসে প্রযুক্তি বিশ্বকে চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছিলেন। চলুন, শুরু করা যাক সেই জাদুকরের গল্প, যার জীবনদর্শন আজও বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষকে ভিন্নভাবে ভাবতে (Think Different) শেখায়।
স্বপ্নের শুরু: এক সাধারণ তরুণের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প
প্রত্যেক বিপ্লবের পেছনে থাকে একটি স্ফুলিঙ্গ। স্টিভ জবসের জীবনে সেই স্ফুলিঙ্গ ছিল তার unconventional বেড়ে ওঠা এবং পৃথিবীকে ভিন্ন চোখে দেখার এক সহজাত ক্ষমতা। তার অসাধারণ হয়ে ওঠার যাত্রার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল তার শৈশব এবং যৌবনের সেই দিনগুলোতেই, যখন তিনি ছিলেন কেবলই এক স্বপ্নবাজ তরুণ।
দত্তক সন্তান এবং ক্যালিগ্রাফির প্রতি ভালোবাসা
স্টিভ জবসের জন্ম ১৯৫৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, সান ফ্রান্সিসকোতে। তার জন্মদাতা বাবা-মা, আব্দুলফাত্তাহ জান্দালি এবং জোয়ান שיבל, দুজনই অবিবাহিত ছাত্র ছিলেন এবং সেই সময়ে তাদের সন্তানকে বড় করার মতো পরিস্থিতি তাদের ছিল না। তাই জন্মের পরপরই তাকে দত্তক দেওয়া হয় পল এবং ক্লারা জবস দম্পতির কাছে। এই ঘটনাটি স্টিভের জীবনে এক গভীর ছাপ ফেলেছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন, তিনি “পরিত্যক্ত” নন, বরং তাকে “বেছে নেওয়া” হয়েছিল। এই অনুভূতিটি তাকে একদিকে যেমন বিশেষ করে তুলেছিল, তেমনই তার মনে একধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধও তৈরি করেছিল, যা তাকে সারাজীবন স্রোতের বিপরীতে চলতে শিখিয়েছিল।
তার প্রথাগত শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই। স্কুলের গৎবাঁধা পড়াশোনা তাকে কখনোই আকর্ষণ করতে পারেনি। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি ওরেগনের রিড কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, যা ছিল আমেরিকার অন্যতম ব্যয়বহুল একটি কলেজ। কিন্তু মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারেন যে, এই পড়াশোনা তার জন্য নয়। তার বাবা-মায়ের সারাজীবনের সঞ্চয় এমন এক শিক্ষার পেছনে খরচ হচ্ছে যার কোনো উদ্দেশ্য তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাই তিনি কলেজ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু কলেজ ছেড়ে দিলেও তিনি ক্যাম্পাস ছাড়েননি। বন্ধুদের রুমের মেঝেতে ঘুমাতেন, ব্যবহৃত কোকের বোতল ফেরত দিয়ে পাওয়া পয়সা দিয়ে খাবার কিনতেন এবং হরেকৃষ্ণ মন্দিরে বিনামূল্যে খেতে যেতেন। এই কঠিন সময়েই তিনি এমন একটি কাজ করেন যা পরবর্তীতে প্রযুক্তি বিশ্বে এক নীরব বিপ্লব নিয়ে আসে। তিনি রিড কলেজের ক্যালিগ্রাফি বা হস্তলিপি বিদ্যার ক্লাসে অংশ নিতে শুরু করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন টাইপফেস, অক্ষরের মধ্যে স্পেসের তারতম্য এবং সুন্দর টাইপোগ্রাফির শিল্প সম্পর্কে শেখেন। সেই মুহূর্তে তিনি জানতেন না এই জ্ঞান তার জীবনে কীভাবে কাজে লাগবে। কিন্তু প্রায় দশ বছর পর, যখন তিনি এবং তার দল প্রথম ম্যাকিন্টোস কম্পিউটার ডিজাইন করছিলেন, তখন ক্যালিগ্রাফির সেই শিক্ষা তার মনে পড়ে যায়। ম্যাক হলো প্রথম কম্পিউটার যেখানে একাধিক সুন্দর ফন্ট এবং আনুপাতিক স্পেসযুক্ত অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছিল। স্টিভ জবস প্রায়ই বলতেন, “যদি আমি কলেজ না ছাড়তাম, তাহলে হয়তো ক্যালিগ্রাফি ক্লাসটিও করতাম না, আর পার্সোনাল কম্পিউটারে হয়তো কখনোই এত সুন্দর টাইপোগ্রাফি থাকত না।”
গ্যারেজে অ্যাপলের জন্ম এবং স্টিভ ওজনিয়াক
স্টিভ জবসের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল একজন প্রকৌশলী জাদুকরের। আর সেই জাদুকরের নাম ছিল স্টিভ ওজনিয়াক, যিনি “ওজ” নামে পরিচিত ছিলেন। ওজ ছিলেন একজন জিনিয়াস ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, যিনি মজা করার জন্য সার্কিট বোর্ড ডিজাইন করতেন। অন্যদিকে, জবস ছিলেন একজন ভিশনারি, যিনি প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন এবং জানতেন কীভাবে একটি আইডিয়াকে পণ্যে রূপান্তরিত করে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হয়। তাদের দুজনের দেখা হওয়াটা ছিল যেন আগুন আর বারুদের মিলন।
১৯৭৬ সাল। জবসের বয়স তখন মাত্র ২১। তিনি ওজনিয়াককে রাজি করালেন তার ডিজাইন করা একটি পার্সোনাল কম্পিউটার সার্কিট বোর্ডকে تجارتی রূপ দিতে। তাদের কর্মক্ষেত্র ছিল জবসের পালক বাবা-মায়ের বাড়ির সেই বিখ্যাত গ্যারেজ। সামান্য কিছু পুঁজি—জবস তার ভক্সওয়াগেন মাইক্রোবাস এবং ওজনিয়াক তার প্রিয় হিউলেট-প্যাকার্ড ক্যালকুলেটর বিক্রি করে ১৩০০ ডলার জোগাড় করেন। সেই টাকা দিয়েই তারা প্রতিষ্ঠা করেন ‘অ্যাপল কম্পিউটার কোম্পানি’।
তাদের প্রথম পণ্য ছিল Apple I—একটি মাদারবোর্ড যা ব্যবহারকারীকে নিজের কেসিং, কিবোর্ড এবং মনিটর যোগ করে একটি পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটার তৈরি করতে হতো। এটি ছিল মূলত কম্পিউটার المهووسينদের জন্য একটি পণ্য। কিন্তু জবস এখানেই থেমে থাকতে চাননি। তিনি এমন একটি কম্পিউটার তৈরি করতে চেয়েছিলেন যা সাধারণ মানুষও সহজে ব্যবহার করতে পারবে। এই স্বপ্ন থেকেই জন্ম নেয় Apple II, যা পার্সোনাল কম্পিউটার জগতে এক বিপ্লব নিয়ে আসে। এটি ছিল প্রথম কম্পিউটার যা একটি সুন্দর প্লাস্টিকের কেসিং এবং রঙিন গ্রাফিক্সসহ বাজারে আসে। জবস এবং ওজনিয়াকের সেই গ্যারেজে শুরু হওয়া ছোট্ট কোম্পানিটি মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই একটি মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং স্টিভ জবস প্রযুক্তি বিশ্বের এক নতুন তারকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
উত্থান, পতন এবং পুনরুত্থান: এক মহাকাব্যিক যাত্রা
সাফল্যের চূড়ায় ওঠার পথ কখনোই মসৃণ হয় না। স্টিভ জবসের জীবন ছিল এর এক জীবন্ত প্রমাণ। অ্যাপলকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দেওয়ার পর তাকে এমন এক নাটকীয় পতনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, যা তার জীবনকে চিরদিনের জন্য বদলে দেয়। কিন্তু এই পতনই ছিল তার কিংবদন্তি হয়ে ওঠার গল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
Macintosh-এর বিপ্লব এবং বিজ্ঞাপন জগতের পরিবর্তন
Apple II-এর অভূতপূর্ব সাফল্যের পর স্টিভ জবস এমন একটি কম্পিউটার তৈরির স্বপ্ন দেখছিলেন যা প্রযুক্তিকে আরও বেশি মানবিক করে তুলবে। তিনি জেরক্স পার্ক (Xerox PARC) পরিদর্শনে গিয়ে গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস (GUI) এবং মাউসের ধারণা দেখতে পান। তিনি সাথে সাথেই বুঝতে পারেন যে, এটিই কম্পিউটারের ভবিষ্যৎ। এই ধারণা থেকেই তিনি ম্যাকিন্টোস (Macintosh) প্রজেক্টের দায়িত্ব নেন। তার লক্ষ্য ছিল এমন একটি “insanely great” কম্পিউটার তৈরি করা যা ব্যবহারকারীরা দেখেই ভালোবাসবে।
১৯৮৪ সালে ম্যাকিন্টোস বাজারে আসে। এটি ছিল প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সফল পার্সোনাল কম্পিউটার যেখানে মাউস এবং GUI ব্যবহার করা হয়েছিল। ব্যবহারকারীরা আর জটিল কমান্ড লাইন মনে রাখার পরিবর্তে স্ক্রিনের আইকনে ক্লিক করে কম্পিউটার চালাতে পারত। এটি ছিল প্রযুক্তিকে সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দেওয়ার এক বিশাল পদক্ষেপ।
কিন্তু ম্যাকিন্টোস শুধু তার প্রযুক্তির জন্যই বিখ্যাত হয়নি, এর বিজ্ঞাপনের জন্যও ইতিহাস হয়ে আছে। ১৯৮৪ সালের সুপার বোল খেলার বিরতিতে অ্যাপল তাদের সেই বিখ্যাত বিজ্ঞাপনটি প্রচার করে। রিডলি স্কট পরিচালিত এই বিজ্ঞাপনে জর্জ অরওয়েলের ‘1984’ উপন্যাসের থিম ব্যবহার করে দেখানো হয় যে, একজন বিদ্রোহী নারী IBM-এর মতো একনায়কতান্ত্রিক শক্তির পর্দাকে হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। বিজ্ঞাপনের শেষে বার্তা ছিল: “On January 24th, Apple Computer will introduce Macintosh. And you’ll see why 1984 won’t be like ‘1984’.” এই বিজ্ঞাপনটি শুধু একটি পণ্য বিক্রি করেনি, এটি অ্যাপলকে একটি বিদ্রোহী, সৃজনশীল এবং статус ক্যু-কে চ্যালেঞ্জ করা এক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল।
অ্যাপল থেকে বিতাড়ন: এক বেদনাদায়ক অধ্যায়
ম্যাকিন্টোসের সাফল্য সত্ত্বেও অ্যাপলের ভেতরে তখন চলছিল ক্ষমতার এক তীব্র লড়াই। স্টিভ জবসের জেদি, খামখেয়ালি এবং পারফেকশনিস্ট স্বভাবের কারণে তার সাথে কোম্পানির অন্যদের সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করে। তিনি পেপসি থেকে জন স্কালিকে অ্যাপলের CEO হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন এই বিখ্যাত উক্তিটি করে: “Do you want to sell sugared water for the rest of your life, or do you want to come with me and change the world?” (তুমি কি সারাজীবন মিষ্টি পানি বিক্রি করতে চাও, নাকি আমার সাথে এসে мирকে বদলে দিতে চাও?)
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তার সেই পছন্দের মানুষটির সাথেই তার বিরোধ চরমে ওঠে। ম্যাকিন্টোসের ধীরগতির বিক্রি এবং জবসের আগ্রাসী আচরণের কারণে কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস স্কালির পক্ষ নেয়। ১৯৮৫ সালে, মাত্র ৩০ বছর বয়সে, স্টিভ জবসকে তার নিজের হাতে গড়া অ্যাপল কম্পিউটার থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এটি ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত। তিনি পরবর্তীতে বলেছিলেন, “আমার জীবনের যেটা মূল ফোকাস ছিল, তা হারিয়ে গিয়েছিল, এবং এটা ছিল বিধ্বংসী।” পুরো প্রযুক্তি বিশ্ব তখন ধরে নিয়েছিল যে, স্টিভ জবসের বর্ণময় অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি ঘটল।
NeXT এবং Pixar: ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির উত্থান
অ্যাপল থেকে বিতাড়িত হয়ে জবস কিছুদিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার ভেতরের আগুন তখনও নেভেনি। তিনি এই ব্যর্থতাকে একটি নতুন সুযোগ হিসেবে দেখলেন। তিনি বলতেন, “আমার উপর থেকে সফল হওয়ার ভারী বোঝাটা সরে গিয়ে নতুন করে শুরু করার হালকা অনুভূতিতে পরিণত হয়েছিল।” এই নতুন স্বাধীনতা নিয়ে তিনি দুটি নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন যা আবারও প্রযুক্তি ও বিনোদন জগতে বিপ্লব নিয়ে আসে।
তার প্রথম কোম্পানি ছিল NeXT Computer। তিনি উচ্চশিক্ষা এবং ব্যবসায়িক বাজারের জন্য একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও আধুনিক কম্পিউটার তৈরি করতে চেয়েছিলেন। NeXT কম্পিউটার বাণিজ্যিক ভাবে খুব বেশি সফল হতে পারেনি, কারণ এর দাম ছিল অনেক বেশি। কিন্তু এর অবজেক্ট-ওরিয়েন্টেড অপারেটিং সিস্টেম NeXTSTEP ছিল সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। কাকতালীয়ভাবে, এই প্রযুক্তিই এক দশক পরে অ্যাপলকে বাঁচাতে সাহায্য করেছিল।
তার দ্বিতীয় এবং সম্ভবত আরও যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল পিক্সার (Pixar) নামক একটি ছোট গ্রাফিক্স হার্ডওয়্যার কোম্পানি কিনে নেওয়া। তিনি জর্জ লুকাসের কাছ থেকে মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলারে কোম্পানিটি কিনে নেন। জবসের নেতৃত্বে এবং অর্থায়নে পিক্সার ধীরে ধীরে একটি কম্পিউটার অ্যানিমেশন স্টুডিওতে রূপান্তরিত হয়। ১৯৯৫ সালে পিক্সার তাদের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র ‘টয় স্টোরি’ (Toy Story) মুক্তি দেয়। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম সম্পূর্ণ কম্পিউটার-তৈরি চলচ্চিত্র এবং এটি বিশ্বজুড়ে বক্স অফিসে ঝড় তোলে। এই এক সিনেমা দিয়েই পিক্সার অ্যানিমেশন জগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে এবং স্টিভ জবস একজন সফল বিলিয়নেয়ার হিসেবে বিনোদন জগতে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। যে মানুষটিকে একদিন ব্যর্থ বলে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল, তিনিই তখন দুটি ভিন্ন শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন। তার জীবনের পরবর্তী, এবং সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায়ের জন্য মঞ্চ তখন প্রস্তুত।
অ্যাপলে প্রত্যাবর্তন: প্রযুক্তির ইতিহাসে দ্বিতীয় বিপ্লব
রূপকথার গল্পের মতোই, নির্বাসিত রাজা তার রাজ্যে ফিরে এসেছিলেন। ১৯৯৬ সাল। অ্যাপল তখন তার ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। একের পর এক ব্যর্থ পণ্য, दिशाहीन নেতৃত্ব এবং অপারেটিং সিস্টেম মারাত্মক সংকটের কারণে কোম্পানিটি দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে, অ্যাপল একটি মরিয়া সিদ্ধান্ত নেয়—তারা ৪২৯ মিলিয়ন ডলারে স্টিভ জবসের কোম্পানি NeXT-কে কিনে নেয়। এই চুক্তির মাধ্যমে স্টিভ জবস পরামর্শক হিসেবে তার নিজের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে ফিরে আসেন। এটি ছিল প্রযুক্তি ইতিহাসের অন্যতম সেরা প্রত্যাবর্তন।
দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে অ্যাপলে প্রত্যাবর্তন এবং “Think Different”
জবস যখন অ্যাপলে ফিরে আসেন, তখন কোম্পানির অবস্থা ছিল ভয়াবহ। কর্মীরা ছিল হতাশ, আর বিনিয়োগকারীরা ছিল আতঙ্কিত। জবস দ্রুতই কোম্পানির অন্তর্বর্তীকালীন সিইও (iCEO) হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং কঠোর হাতে সব অপ্রয়োজনীয় প্রজেক্ট বন্ধ করে দেন। তিনি কোম্পানির পণ্য তালিকাকে মাত্র কয়েকটি মূল পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেন।
কিন্তু শুধু আর্থিক পুনর্গঠনই যথেষ্ট ছিল না। জবস বুঝতে পেরেছিলেন যে, অ্যাপলের যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হলো তার হারানো আত্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনা। আর এই লক্ষ্যেই ১৯৯৭ সালে তিনি চালু করেন সেই কিংবদন্তিতুল্য বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইন—”Think Different”। এই বিজ্ঞাপনে অ্যাপলের কোনো পণ্যের ছবি ছিল না। ছিল কেবল আইনস্টাইন, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, মহাত্মা গান্ধীর মতো ইতিহাস বদলে দেওয়া “পাগল” মানুষদের ছবি। বিজ্ঞাপনের ভয়েসওভারে বলা হচ্ছিল: “Here’s to the crazy ones, the misfits, the rebels… because the people who are crazy enough to think they can change the world, are the ones who do.”
এই বিজ্ঞাপনটি ছিল এক মাস্টারস্ট্রোক। এটি কর্মীদের এবং গ্রাহকদের মনে করিয়ে দিয়েছিল যে অ্যাপল শুধু একটি কম্পিউটার কোম্পানি নয়, এটি একটি আদর্শ। এটি সেইসব মানুষের জন্য, যারা গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে ভিন্নভাবে ভাবতে সাহস করে। এই এক ক্যাম্পেইন দিয়েই জবস অ্যাপলের মৃত্যুপথযাত্রী ব্র্যান্ডটিকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
iMac থেকে iPod: ডিজাইন ও সংগীতে বিপ্লব
অ্যাপলের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার পর জবসের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল এমন একটি পণ্য তৈরি করা যা বিশ্বকে আবার তাক লাগিয়ে দেবে। এই সময়েই তিনি তার সৃষ্টিশীল সঙ্গী, ব্রিটিশ ডিজাইন জিনিয়াস জনি আইভকে খুঁজে পান। তাদের দুজনের রসায়ন ছিল অবিশ্বাস্য। জবসের ভিশন এবং আইভের ডিজাইন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
তাদের জুটির প্রথম বিস্ময়কর সৃষ্টি ছিল ১৯৯৮ সালে বাজারে আসা iMac G3। সেই সময়ে কম্পিউটার মানেই ছিল ধূসর রঙের বিরক্তিকর একটি বাক্স। কিন্তু iMac ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। উজ্জ্বল রঙের (Bondi Blue) স্বচ্ছ প্লাস্টিকের আবরণে তৈরি এই অল-ইন-ওয়ান কম্পিউটারটি দেখতে ছিল অসাধারণ। এটি শুধু একটি শক্তিশালী যন্ত্র ছিল না, এটি ছিল একটি ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। iMac রাতারাতি বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এবং অ্যাপলকে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে লাভের ধারায় ফিরিয়ে আনে।
এরপর ২০০১ সালে জবস প্রযুক্তি বিশ্বকে উপহার দেন তার আরেকটি যুগান্তকারী পণ্য—iPod। তখন বাজারে এমপিথ্রি প্লেয়ার থাকলেও সেগুলো ছিল громіздкий এবং ব্যবহার করা ছিল কঠিন। জবস এমন একটি ডিভাইস চাইলেন যা হবে ছোট, সুন্দর এবং যেখানে হাজার হাজার গান রাখা যাবে। ফলাফল ছিল iPod, যার বিজ্ঞাপনের স্লোগান ছিল—”1,000 songs in your pocket”। আইপডের সাথে তিনি আইটিউনস মিউজিক স্টোর চালু করেন, যা মানুষকে প্রথমবারের মতো বৈধভাবে ডিজিটাল উপায়ে গান কেনার সুযোগ করে দেয়। এই দুটি মিলে সংগীত শিল্পে এক অভূতপূর্ব বিপ্লব নিয়ে আসে এবং অ্যাপলকে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী বিনোদন কোম্পানিতে পরিণত করে।
iPhone এবং iPad: প্রযুক্তি বিশ্বের পুনঃসংজ্ঞায়ন
২০০৭ সালের ৯ জানুয়ারি। সান ফ্রান্সিসকোর মঞ্চে স্টিভ জবস তার সেই বিখ্যাত কালো টার্টলনেক পরে দাঁড়ালেন এবং প্রযুক্তি বিশ্বের ইতিহাস চিরদিনের জন্য বদলে দিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, “আজ আমরা তিনটি বিপ্লবী পণ্য উন্মোচন করতে চলেছি: একটি ওয়াইডস্ক্রিন আইপড, একটি বিপ্লবী মোবাইল ফোন এবং একটি যুগান্তকারী ইন্টারনেট কমিউনিকেটর… আর এই তিনটি কোনো আলাদা ডিভাইস নয়, এটি একটিই ডিভাইস, এবং আমরা এর নাম দিয়েছি iPhone।”
আইফোন ছিল এককথায় একটি জادو। এর মাল্টি-টাচ ইন্টারফেস, ফুল-স্ক্রিন ডিসপ্লে এবং শক্তিশালী সফটওয়্যার মোবাইল ফোনের ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিল। এর এক বছর পর তিনি অ্যাপ স্টোর চালু করেন, যা ডেভেলপারদের জন্য একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেয় এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন জগতে এক বিলিয়ন-ডলারের অর্থনীতির জন্ম দেয়। আইফোন শুধু একটি সফল পণ্য ছিল না; এটি আমাদের যোগাযোগ, কাজ, বিনোদন এবং জীবনযাপনের পদ্ধতিকেই বদলে দিয়েছে।
আইফোনের সাফল্যের পর, ২০১০ সালে তিনি আরেকটি নতুন ক্যাটাগরির পণ্য তৈরি করেন—iPad। অনেকেই তখন এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, কিন্তু জবস প্রমাণ করে ছাড়েন যে ল্যাপটপ এবং স্মার্টফোনের মাঝামাঝি একটি ডিভাইসেরও বিশাল বাজার রয়েছে। আইপ্যাড ট্যাবলেট কম্পিউটিংকে মূলধারায় নিয়ে আসে এবং অ্যাপলের সাফল্যের মুকুটে আরেকটি নতুন পালক যোগ করে।
স্টিভ জবসের দর্শন এবং রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার
স্টিভ জবস শুধু কয়েকটি সফল পণ্য তৈরি করেননি; তিনি এমন এক দর্শন রেখে গেছেন যা আজও অ্যাপল এবং বিশ্বজুড়ে অগণিত উদ্যোক্তাকে পথ দেখায়। তার সাফল্য লুকিয়ে ছিল তার কাজের পদ্ধতির গভীরে।
ডিজাইন এবং সরলতার প্রতি আবেশ (Obsession)
স্টিভ জবসের জন্য, ডিজাইন শুধু দেখতে সুন্দর হওয়া নয়। তার বিখ্যাত উক্তি ছিল, “Design is not just what it looks like and feels like. Design is how it works.” (ডিজাইন শুধু দেখতে বা অনুভব করতে কেমন, তা নয়। ডিজাইন হলো এটি কীভাবে কাজ করে।) তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রযুক্তি যত জটিলই হোক না কেন, ব্যবহারকারীর কাছে তা পৌঁছাতে হবে সবচেয়ে সহজ এবং সুন্দর উপায়ে।
তার এই সরলতার প্রতি одержимость ছিল কিংবদন্তিতুল্য। তিনি পণ্যের প্রতিটি ছোটখাটো বিষয় নিয়েও মাথা ঘামাতেন—পণ্যের ভেতরের সার্কিট বোর্ডের বিন্যাস থেকে শুরু করে বাইরের প্যাকেজিং পর্যন্ত। তিনি চাইতেন, গ্রাহক যেন বাক্স খোলার মুহূর্ত থেকেই এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা লাভ করে। তার এই পারফেকশনিজম এবং ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতার প্রতি গভীর মনোযোগই অ্যাপলের পণ্যগুলোকে প্রতিযোগীদের থেকে আলাদা করে তুলেছে।
“Stay Hungry, Stay Foolish“: তার জীবনের মূলমন্ত্র
২০০৫ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে স্টিভ জবস তার জীবনের অন্যতম সেরা এবং অনুপ্রেরণামূলক ভাষণটি দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তার জীবনের তিনটি গল্প বলেন এবং শেষ করেন ‘The Whole Earth Catalog’ নামক একটি পুরনো ম্যাগাজিনের শেষ সংখ্যার একটি উক্তি দিয়ে: “Stay Hungry, Stay Foolish.”
“Stay Hungry” বা “জ্ঞানপিপাসু থেকো” বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, কখনো শেখা থামিও না, কখনো ভেবো না যে তুমি সবকিছু জেনে গেছ। সবসময় নতুন কিছু জানার জন্য ক্ষুধার্ত থেকো। আর “Stay Foolish” বা “বোকা থেকো” বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, প্রচলিত ধ্যানধারণা বা তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের কথায় কান না দিয়ে নিজের মন এবং உள்ளுணர்কে অনুসরণ করার সাহস রেখো। কারণ যারা বোকার মতো অসম্ভবকে সম্ভব করার স্বপ্ন দেখে, তারাই একদিন мирকে বদলে দেয়। এই দুটি বাক্যই ছিল তার পুরো জীবনের সারসংক্ষেপ।
রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার: অ্যাপল এবং তার পরেও
২০১১ সালের ৫ অক্টোবর, अग्न्याशয়ের ক্যান্সারের সাথে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর স্টিভ জবস মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তিনি যা রেখে গেছেন, তা অমর। তিনি শুধু অ্যাপলকে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানিতে পরিণত করেননি; তিনি এমন এক উদ্ভাবনী সংস্কৃতি তৈরি করে গেছেন যা আজও প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। তিনি একা হাতে অন্তত ছয়টি শিল্পকে বদলে দিয়েছেন: পার্সোনাল কম্পিউটার (Apple II, Mac), অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র (Pixar), সংগীত (iPod, iTunes), ফোন (iPhone), ট্যাবলেট কম্পিউটিং (iPad) এবং ডিজিটাল প্রকাশনা (iBooks)। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে প্রযুক্তি এবং মানবিকতাকে একসাথে মেলানো যায়। তার সেই বিখ্যাত উক্তি, “Put a dent in the universe” (মহাবিশ্বে একটি ছাপ রেখে যাও), আজও বিশ্বজুড়ে সেইসব স্বপ্নবাজদের অনুপ্রেরণা জোগায় যারা мирকে আরও সুন্দর একটি জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে চায়।
উপসংহার (Conclusion)
স্টিভ জবসের জীবন ছিল এক মহাকাব্য। গ্যারেজে শুরু হওয়া এক সাধারণ তরুণের স্বপ্ন থেকে শুরু করে প্রযুক্তি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার এক অবিশ্বাস্য যাত্রা। তার জীবনে ছিল উত্থান, ছিল বেদনাদায়ক পতন এবং ছিল রূপকথার মতো প্রত্যাবর্তন। তিনি ছিলেন এক জটিল চরিত্রের মানুষ—একই সাথে অনুপ্রেরণাদায়ী এবং বিতর্কিত। কিন্তু তার প্রতিভা এবং দূরদৃষ্টি নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে হয়, কীভাবে সরলতার মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজে পেতে হয় এবং কীভাবে নিজের কাজের প্রতি তীব্র ভালোবাসা দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করতে হয়। স্টিভ জবস শুধু পণ্য তৈরি করেননি, তিনি অভিজ্ঞতা তৈরি করেছেন, তিনি ভবিষ্যৎ তৈরি করেছেন। তিনি মহাবিশ্বে যে ছাপ রেখে গেছেন, তা কোনোদিন মুছে যাওয়ার নয়।
স্টিভ জবসের কোন উদ্ভাবনটি আপনার জীবনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে? কমেন্টে আপনার মতামত জানান এবং এই অসাধারণ গল্পটি অন্যদের সাথে শেয়ার করে তাদেরও স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করুন।