সৌদি আরবে ব্যবসা: এক বাংলাদেশির ৭ বছরের সফলতার গল্প
স্বপ্ন পূরণের পথে প্রথম পদক্ষেপ
আজ থেকে সাত বছর আগে যখন রিয়াদের কিং খালিদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটিতে প্রথম পা রাখি, তখন চোখে ছিল একরাশ স্বপ্ন আর বুকে ছিল অজানা এক ভয়। চারপাশের আরবি কোলাহল, মরুভূমির উত্তপ্ত বাতাস আর নতুন এক পরিবেশ—সবকিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। আমি শুধু একজন প্রবাসী কর্মী হিসেবে আসিনি, এসেছিলাম একজন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। সাথে ছিল সামান্য কিছু সঞ্চয় আর অফুরন্ত সাহস। অনেকেই বলেছিল, “সৌদিতে ব্যবসা করা অনেক কঠিন, কফিল (Sponsor) ভালো না হলে সব শেষ,” অথবা “ভাষাই জানো না, কীভাবে কী করবে?” এই সব কথা শুনে ভয় যে লাগেনি, তা নয়। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল, সততা আর কঠোর পরিশ্রম দিয়ে যেকোনো প্রতিকূলতা জয় করা সম্ভব।
এই ব্লগ পোস্টে আমি আমার সেই সাত বছরের যাত্রার গল্পই বলব। কীভাবে একজন সাধারণ বাংলাদেশি হিসেবে আমি সৌদি আরবে নিজের ব্যবসাকে শূন্য থেকে দাঁড় করিয়েছি, সেই গল্প আপনাদের শোনাব। এই দীর্ঘ পথে আমাকে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে, কীভাবে এখানকার জটিল আইনি প্রক্রিয়া সামলেছি, এবং কোন ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়েছি—তার সবই আমি খোলামেলাভাবে তুলে ধরব। আমার এই অভিজ্ঞতা হয়তো আপনার জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে, অথবা যারা ভবিষ্যতে সৌদি আরবে ব্যবসা করার স্বপ্ন দেখছেন, তাদের জন্য একটি বাস্তবসম্মত পথনির্দেশিকা হিসেবে কাজ করতে পারে। চলুন, আমার গল্পের সাথে আপনারাও এই রোমাঞ্চকর যাত্রার সঙ্গী হোন।
কেন সৌদি আরব? আমার শুরুর গল্প
প্রবাস জীবন শুরুর আগের কথা
সৌদি আরবে আসার আগে আমি বাংলাদেশের আর দশটা সাধারণ যুবকের মতোই ছিলাম। ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মোটামুটি ভালো বেতনে চাকরি করতাম। কিন্তু মাস শেষে বেতনের টাকা দিয়ে নিজের এবং পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর পর হাতে আর কিছুই থাকত না। আমার ভেতরে সবসময়ই একটা স্বাধীন সত্তা কাজ করত; আমি চাইতাম নিজের মতো করে কিছু করতে, এমন কিছু যা শুধু আমার পরিচয় দেবে না, বরং আরও দশজনের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেবে। চাকরির বাঁধা-ধরা নিয়ম আর সীমিত আয়ের জীবন আমার ভেতরের উদ্যোক্তা সত্তাকে দমিয়ে রাখছিল।
বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা হুট করে নেওয়া নয়। দিনের পর দিন আমি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, ব্যবসার সুযোগ এবং নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতাম। আমি দেখতাম, আমার চারপাশে অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই শ্রমিক হিসেবে যেত। আমার লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। আমি শুধু টাকা আয় করতে চাইনি, আমি চেয়েছিলাম একটি সাম্রাজ্য গড়তে, যা হবে আমার নিজের। তাই আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে, ব্যবসার সুযোগগুলো নিয়ে গবেষণা শুরু করি। পরিবার এবং বন্ধুরা অনেকেই আমার এই সিদ্ধান্তকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেছিল, কিন্তু আমার স্ত্রী আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। তার সমর্থনই ছিল আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।
সৌদি আরবকে বেছে নেওয়ার কারণ
যখন মধ্যপ্রাচ্যের কথা ভাবি, তখন সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার বা কুয়েতের মতো দেশগুলোর নামই প্রথমে মাথায় আসে। কিন্তু দীর্ঘ গবেষণার পর আমি সৌদি আরবকেই আমার গন্তব্য হিসেবে বেছে নিই। এর পেছনে বেশ কয়েকটি শক্ত কারণ ছিল।
প্রথমত, বিশাল বাজার। সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম অর্থনীতি। এখানকার জনসংখ্যা এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দুটোই অনেক বেশি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এখানে যদি কোনো পণ্যের বা সেবার চাহিদা তৈরি করা যায়, তাহলে ব্যবসার প্রসার ঘটানো অনেক সহজ হবে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশি কমিউনিটি। সৌদি আরবে বিশাল এক বাংলাদেশি কমিউনিটি রয়েছে। আমি ভেবেছিলাম, ব্যবসা শুরুর দিকে স্বদেশি ভাইদের সমর্থন পাওয়া গেলে কাজটা অনেক সহজ হবে। তাছাড়া, আমাদের দেশের মানুষের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের বা সেবার একটি বড় বাজার এখানে রয়েছে।
তৃতীয়ত, ধর্মীয় গুরুত্ব। মক্কা ও মদিনার কারণে সারা বিশ্বের মুসলিমদের কাছে এই দেশের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। এই ধর্মীয় আবহ আমার মনে এক ধরনের মানসিক শান্তি ও শক্তি যোগাত।
আমার মূল উদ্দেশ্য চাকরি করা ছিল না। আমি প্রথম থেকেই ব্যবসার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলাম। আমি জানতাম, একজন বিদেশি হিসেবে এখানে সরাসরি ব্যবসা শুরু করা কঠিন। এর জন্য একজন সৌদি নাগরিকের স্পনসরশিপ বা অংশীদারিত্বের প্রয়োজন হয়, যাকে এখানে ‘কফিল’ বলা হয়। আমার পরিকল্পনা ছিল, প্রথমে ছোটখাটো কোনো কাজ বা ব্যবসার সাথে যুক্ত হয়ে এখানকার বাজার, আইনকানুন এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করা এবং একই সাথে একজন ভালো ও বিশ্বাসযোগ্য কফিল খুঁজে বের করা।
নতুন দেশ, নতুন চ্যালেঞ্জ
স্বপ্ন দেখা আর বাস্তবতা এক জিনিস নয়। সৌদি আরবে আসার পর প্রথম কয়েক মাস আমার জন্য ছিল সবচেয়ে কঠিন সময়। প্রথম এবং প্রধান বাধা ছিল ভাষা। আমি কাজ চালানোর মতো কিছু আরবি শব্দ শিখে এসেছিলাম, কিন্তু এখানকার স্থানীয়দের কথার গতি এবং তাদের আঞ্চলিক টান বোঝা আমার জন্য প্রায় অসম্ভব ছিল। দোকানে গিয়ে একটা জিনিস কেনা বা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে নিজের ঠিকানা বোঝানো—এর মতো সাধারণ কাজগুলোও আমার কাছে পাহাড় সমান মনে হতো।
এরপর ছিল সাংস্কৃতিক পার্থক্য। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা, সামাজিক রীতিনীতি, কাজের ধরন—সবকিছুই আমাদের থেকে আলাদা। প্রথমদিকে সবকিছুতেই নিজেকে বড্ড একা আর বেমানান লাগত। দিনের বেলায় প্রখর রোদ আর রাতের বেলায় মরুভূমির শীতল হাওয়া, দুটোই আমার কাছে নতুন ছিল। দেশের জন্য, পরিবারের জন্য মন খারাপ করত। মাঝে মাঝে মনে হতো, সব ছেড়েছুড়ে দেশে ফিরে যাই।
কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। আমি প্রতিদিন নিয়ম করে আরবি শেখার চেষ্টা করতাম। স্থানীয়দের সাথে মিশে তাদের সংস্কৃতি বোঝার চেষ্টা করতাম। ধীরে ধীরে আমি আবিষ্কার করলাম, সৌদিরা অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ এবং বন্ধুত্বসুলভ জাতি। আপনি যদি তাদের সম্মান করেন এবং তাদের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, তাহলে তারা আপনাকে আপন করে নিতে সময় নেবে না। এই ছোট ছোট ইতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলোই আমাকে এখানকার কঠিন পরিবেশে টিকে থাকার এবং আমার স্বপ্নের পেছনে ছোটার সাহস জুগিয়েছে।
স্বপ্নের বাস্তবায়ন: যেভাবে ব্যবসার শুরু, ব্যবসার আইডিয়া খুঁজে পাওয়া
সৌদি আরবে প্রথম বছরটা আমি মূলত পর্যবেক্ষক হিসেবে কাটিয়েছি। একটি ছোট ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে কাজ নিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল এখানকার বাজারকে কাছ থেকে দেখা এবং বোঝা। আমি দেখতাম, এখানে প্রচুর বাংলাদেশি, ভারতীয় এবং পাকিস্তানি থাকেন। তাদের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে নিজ দেশের পণ্য। বিশেষ করে বাংলাদেশি মুদিপণ্য, যেমন—প্রাণ, রাঁধুনী বা ফ্রেশের বিভিন্ন মসলা, আচার, তেল, চাল এবং বিশেষ করে ইলিশ মাছের 엄청 চাহিদা। কিন্তু ভালো মানের পণ্যের সরবরাহ ছিল সীমিত এবং দামও ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। আমি এই শূন্যস্থানটি পূরণ করার একটি বিশাল সম্ভাবনা দেখতে পেলাম।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বাংলাদেশ থেকে সরাসরি মানসম্মত খাদ্যপণ্য আমদানি করে এখানকার পাইকারি এবং খুচরা বাজারে সরবরাহ করব। আইডিয়াটা মাথায় আসার পর আমি প্রায় ছয় মাস ধরে রিয়াদ এবং দাম্মামের বিভিন্ন বাজার ঘুরেছি, দোকানদারদের সাথে কথা বলেছি, এবং গ্রাহকদের চাহিদা বোঝার চেষ্টা করেছি। এই মাঠপর্যায়ের গবেষণাই আমার ব্যবসার ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল।
আইনি প্রক্রিয়া এবং কাগজের লড়াই
ব্যবসার আইডিয়া চূড়ান্ত করার পর শুরু হলো আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়—আইনি প্রক্রিয়া। সৌদি আরবে একজন বিদেশি হিসেবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করাটা তখন ছিল যেন সাত সাগর পাড়ি দেওয়ার মতো। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল একজন সৎ এবং বিশ্বাসযোগ্য কফিল (Sponsor) খুঁজে বের করা। কারণ, আইন অনুযায়ী, ব্যবসার মালিকানার একটি অংশ তার নামে থাকবে। আমি অনেক মানুষের সাথে কথা বলেছি, অনেকের দ্বারস্থ হয়েছি। কিছু অভিজ্ঞতা বেশ তিক্ত ছিল।
অবশেষে, আমার এক পরিচিতের মাধ্যমে একজন বয়স্ক সৌদি নাগরিকের সাথে পরিচয় হয়। তিনি অত্যন্ত ভদ্র এবং ধার্মিক ছিলেন। কয়েক মাস তার সাথে মেশার পর এবং আমার পরিকল্পনা বিস্তারিত জানানোর পর তিনি আমাকে স্পনসর করতে রাজি হন। এটা ছিল আমার প্রথম বড় জয়।
এরপর শুরু হলো অফুরন্ত কাগজের কাজ। ট্রেড লাইসেন্স (সিআর), চেম্বার অফ কমার্সের রেজিস্ট্রেশন, বালাদিয়া (পৌরসভা) লাইসেন্স, এবং আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র—এই সবকিছুর জন্য আমাকে দিনের পর দিন বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ঘুরতে হয়েছে। আরবি ভাষায় দুর্বল হওয়ার কারণে প্রতিটি ধাপে আমাকে দোভাষীর সাহায্য নিতে হয়েছে। অনেক সময় একটা সইয়ের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রায় আট মাস সময় লেগেছিল। এই সময়টা ছিল ধৈর্যের এক চরম পরীক্ষা।
প্রাথমিক বিনিয়োগ এবং অর্থের যোগান
ব্যবসা শুরুর জন্য আমার একটি ভালো পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন ছিল। লাইসেন্স এবং অন্যান্য আইনি কাগজপত্রের পেছনেই বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিল। এরপর অফিস ও গোডাউন ভাড়া, প্রথম চালানের জন্য পণ্যের অর্ডার এবং আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন ছিল, তা আমার একার জমানো টাকা দিয়ে সম্ভব ছিল না।
আমি আমার জমানো সব টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ করি। বাকি অর্থের জন্য আমি বাংলাদেশে আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করি এবং আমার পরিকল্পনা তাদের বিস্তারিতভাবে জানাই। আমার বাবা এবং বড় ভাই আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন এবং আমাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন। তাদের পাঠানো টাকা এবং আমার নিজের সঞ্চয় মিলিয়ে আমি প্রাথমিক মূলধন সংগ্রহ করি। প্রতিটি রিয়াল আমি খুব সাবধানে খরচ করেছি, কারণ আমি জানতাম, এই টাকার ওপর আমার স্বপ্ন এবং আমার পরিবারের বিশ্বাস জড়িয়ে আছে।
প্রথম কয়েক বছর: সংগ্রাম এবং ছোট ছোট অর্জন, প্রথম গ্রাহক এবং পরিচিতি বাড়ানোর কৌশল
ব্যবসার সবকিছু প্রস্তুত—গোডাউনে বাংলাদেশ থেকে আনা পণ্যের প্রথম চালান এসে পৌঁছেছে। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিক্রি করা। আমার প্রথম গ্রাহক ছিলেন রিয়াদের বাথা মার্কেটের একজন বাংলাদেশি দোকানদার, সালাম ভাই। আমি তার দোকানে গিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আমার পণ্যের গুণগত মান এবং তুলনামূলক কম দামের কথা বুঝিয়েছিলাম। তিনি প্রথমে সামান্য কিছু পণ্য নিতে রাজি হন। সেই প্রথম বিক্রির টাকা হাতে পাওয়ার অনুভূতি আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। ওটা শুধু টাকা ছিল না, ওটা ছিল আমার স্বপ্নের প্রথম স্বীকৃতি।
শুরুর দিকে আমি নিজেই গাড়িতে করে বিভিন্ন দোকানে পণ্য পৌঁছে দিতাম। বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে, যেমন—হারা, বাথা, ওলাইয়া—এসব জায়গায় আমি প্রতিটি দোকানে গিয়েছি। পরিচিতি বাড়ানোর জন্য আমি মুখের কথার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত করতাম যেন আমার পণ্যের মান এবং সেবা দুটোই সেরা হয়। ধীরে ধীরে এক দোকান থেকে আরেক দোকানে আমার নাম ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আমি বাংলাদেশি কমিউনিটির বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে সক্রিয় ছিলাম এবং সেখানে আমার ব্যবসার প্রচার করতাম।
সৌদি আরবের বাজার বোঝা
ব্যবসা করতে নেমে আমি বুঝলাম, শুধু বাংলাদেশিদের ওপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না। আমাকে স্থানীয় সৌদি এবং অন্যান্য দেশের প্রবাসীদের কাছেও পৌঁছাতে হবে। আমি লক্ষ্য করলাম, কিছু বাংলাদেশি পণ্য, যেমন—ভালো মানের সরিষার তেল, ঘি, এবং কিছু বিশেষ মসলার চাহিদা সৌদি এবং অন্যান্য আরব দেশের নাগরিকদের মধ্যেও রয়েছে। আমি সেই অনুযায়ী আমার পণ্যের তালিকায় বৈচিত্র্য আনি।
বাজার বুঝতে গিয়ে আমি কিছু ভুলও করেছি। যেমন, একবার আমি ভেবেছিলাম, বাংলাদেশের মতো এখানেও নির্দিষ্ট কিছু স্ন্যাকস খুব চলবে। কিন্তু এখানকার মানুষের রুচি ভিন্ন হওয়ায় সেই পণ্যগুলো তেমন বিক্রি হয়নি। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি শিখি যে, যেকোনো নতুন পণ্য আনার আগে ছোট পরিসরে বাজার পরীক্ষা করে নেওয়াটা জরুরি। প্রতিযোগীদের কৌশল পর্যবেক্ষণ করা এবং তাদের থেকে শিক্ষা নেওয়াটাও আমার রুটিনের অংশ হয়ে গিয়েছিল।
বড় বাধাগুলো যেভাবে অতিক্রম করেছি
ব্যবসার পথে বড় ধরনের বাধাও এসেছে। একবার আমার একটি বড় চালান কাস্টমসে প্রায় এক মাস আটকে ছিল। কিছু কাগজপত্রের জটিলতার কারণে তারা ছাড়পত্র দিচ্ছিল না। গোডাউনে পণ্যের মজুত প্রায় শেষ, দোকানদাররা প্রতিদিন ফোন দিচ্ছে, কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছিলাম না। প্রতিদিন কাস্টমস অফিসে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে আমি প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।
অবশেষে, আমার কফিলের সাহায্যে এবং একজন ক্লিয়ারিং এজেন্টের সহায়তায় আমি সেই সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হই। এই ঘটনা আমাকে শিখিয়েছে যে, যেকোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখা এবং সঠিক মানুষের সাহায্য নেওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বাকিতে পণ্য বিক্রি করা। শুরুর দিকে অনেক দোকানদারই বাকিতে পণ্য নিত এবং সময়মতো টাকা দিত না। এতে আমার ক্যাশ ফ্লোতে মারাত্মক প্রভাব পড়ত। এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য আমি ধীরে ধীরে একটি কঠোর ক্রেডিট পলিসি তৈরি করি এবং বিশ্বস্ত গ্রাহকদের ছাড়া বাকিতে লেনদেন বন্ধ করে দিই।
ব্যবসার প্রসার এবং ৭ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া শিক্ষা, ছোট থেকে বড় হওয়ার গল্প
প্রথম দুই বছরের কঠিন সংগ্রামের পর আমার ব্যবসা ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হতে শুরু করে। বাজারের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে আমি আমার ব্যবসার পরিধিও বাড়াতে থাকি। যে কাজ আমি একা শুরু করেছিলাম, সেখানে আমি প্রথম কর্মচারী নিয়োগ দিই। এরপর একে একে ডেলিভারি ভ্যান কিনি, গোডাউনের আকার বড় করি এবং জেদ্দা ও দাম্মামে আমাদের পণ্য সরবরাহ শুরু করি।
ব্যবসা প্রসারের ক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত ছিল একটি নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করা। আমি বাছাই করা কিছু পণ্য নিজের ব্র্যান্ডের নামে প্যাকেজিং করে বাজারজাত করা শুরু করি। এতে পণ্যের ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ বাড়ে এবং গ্রাহকদের কাছে আমার একটি স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি হয়। আজ সাত বছর পর, আমার প্রতিষ্ঠানে দশজনের বেশি কর্মী কাজ করছে এবং সৌদি আরবের প্রধান শহরগুলোতে আমাদের পণ্যের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে।
সৌদি ভিশন ২০৩০ এবং নতুন সম্ভাবনা
সৌদি আরবের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ব্যবসার জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘ভিশন ২০৩০’ নীতির ফলে পুরো দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য নিয়মকানুন অনেক সহজ করা হয়েছে। এখন কফিলের ওপর নির্ভরশীলতা কমেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই শতভাগ বিদেশি মালিকানায় ব্যবসা করা সম্ভব হচ্ছে।
এই নতুন নীতি আমার ব্যবসার জন্যও নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। আমি এখন ই-কমার্সের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি, কারণ সৌদি আরবে অনলাইন কেনাকাটা দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। এছাড়া, সরকার যেহেতু পর্যটন এবং বিনোদন খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে, তাই এই সম্পর্কিত ব্যবসারও বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
আমার ৭ বছরের সেরা ৩টি ব্যবসায়িক শিক্ষা
এই দীর্ঘ পথচলায় আমি যা শিখেছি, তা কোনো বই পড়ে শেখা সম্ভব নয়। আমার সেরা তিনটি শিক্ষা হলো:
- সম্পর্কই মূলধন: এই দেশে ব্যবসা করতে হলে ভালো সম্পর্ক তৈরির কোনো বিকল্প নেই। আপনার কফিল, আপনার কর্মচারী, আপনার গ্রাহক এবং সরবরাহকারী—সবার সাথে সৎ এবং আস্থাশীল সম্পর্ক বজায় রাখাটা ব্যবসার সাফল্যের চাবিকাঠি।
- মানের সাথে আপস নয়: বাজার প্রতিযোগিতাপূর্ণ। এখানে টিকে থাকতে হলে আপনার পণ্য বা সেবার মান সেরা হতে হবে। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি বাংলাদেশ থেকে সেরা মানের পণ্য আমদানি করতে, যা আমাকে গ্রাহকদের বিশ্বাস অর্জনে সাহায্য করেছে।
- আইন মেনে চলুন: সৌদি আরবের আইনকানুন অত্যন্ত কঠোর। কোনো ধরনের শর্টকাট বা বেআইনি পথে হাঁটার চেষ্টা করলে বিপদ অনিবার্য। সবসময় দেশের আইন ও নিয়ম মেনে ব্যবসা পরিচালনা করাটা দীর্ঘমেয়াদে আপনার জন্যই মঙ্গলজনক।
একজন বাংলাদেশি উদ্যোক্তা হিসেবে সৌদি আরবে আমার জীবন, কাজ এবং ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য
একজন উদ্যোক্তার জীবন কখনোই ৯টা-৫টার রুটিনে বাঁধা থাকে না। আমার দিন শুরু হয় ফজরের নামাজের পর। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যবসার বিভিন্ন দিক—অর্ডার নেওয়া, সরবরাহ নিশ্চিত করা, হিসাবরক্ষণ এবং কর্মীদের পরিচালনা করা—এই সবকিছুতেই আমাকে নজর রাখতে হয়। ছুটির দিনেও অনেক সময় কাজ করতে হয়।
তবে আমি চেষ্টা করি কাজ এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে একটি ভারসাম্য রাখতে। সপ্তাহে একদিন আমি পুরোপুরি পরিবারকে সময় দিই। এখানকার বাংলাদেশি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিই, একসাথে ঘুরতে যাই। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই আমাকে নতুন করে কাজ করার শক্তি জোগায়।
বাংলাদেশি কমিউনিটির ভূমিকা
সৌদি আরবে বাংলাদেশি কমিউনিটি আমার জন্য একটি বড় আশীর্বাদ। এখানে আমরা সবাই একে অপরের সুখে-দুঃখে পাশে থাকার চেষ্টা করি। ব্যবসার শুরুর দিকে অনেক তথ্য এবং সাহায্য আমি কমিউনিটির বড় ভাইদের কাছ থেকেই পেয়েছি। এখানকার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে দেশের অভাবটা কিছুটা হলেও ভুলে থাকার চেষ্টা করি। এই কমিউনিটিই এখানে আমার দ্বিতীয় পরিবার।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং নতুনদের জন্য আমার পরামর্শ, আমার ব্যবসার ভবিষ্যৎ
আগামী পাঁচ বছরে আমি আমার ব্যবসাকে আরও প্রসারিত করতে চাই। আমার লক্ষ্য হলো সৌদি আরবের প্রতিটি ছোট-বড় শহরে আমার নিজস্ব ব্র্যান্ডের পণ্য পৌঁছে দেওয়া। একটি আধুনিক এবং ব্যবহারকারী-বান্ধব ই-কমার্স ওয়েবসাইট এবং মোবাইল অ্যাপ চালু করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি। এছাড়া, খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি অন্যান্য বাংলাদেশি পণ্য, যেমন—পোশাক এবং হস্তশিল্প—আমদানি করারও ইচ্ছা আছে।
যারা সৌদি আরবে ব্যবসা করতে চান তাদের জন্য কিছু টিপস
আমার অভিজ্ঞতা থেকে নতুনদের জন্য কিছু পরামর্শ:
- কী করবেন:
- গবেষণা করুন: এখানে আসার আগে ভালোভাবে বাজার গবেষণা করুন। কোন খাতে ব্যবসার সুযোগ বেশি, তা বোঝার চেষ্টা করুন।
- ভাষা শিখুন: কাজ চালানোর মতো আরবি ভাষা শিখে আসাটা আপনাকে অনেক এগিয়ে রাখবে।
- ধৈর্য ধরুন: এখানে সবকিছুতেই সময় লাগে। রাতারাতি সফল হওয়ার আশা করবেন না। ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হবে।
- নেটওয়ার্ক তৈরি করুন: স্থানীয় এবং বাংলাদেশি কমিউনিটির সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করুন। কী করবেন না:
- না জেনে বড় বিনিয়োগ করবেন না: শুরুতে ছোট পরিসরে কাজ শুরু করুন। বাজার বুঝে তারপর বিনিয়োগ বাড়ান।
- আইন ভাঙবেন না: কোনো অবস্থাতেই দেশের আইন অমান্য করবেন না। এর परिणाम খুব ভয়াবহ হতে পারে।
অন্ধভাবে বিশ্বাস করবেন না: বিশেষ করে কফিল বা ব্যবসায়িক অংশীদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকুন। সবকিছু লিখিতভাবে এবং আইন অনুযায়ী করুন।
উপসংহার: ৭ বছরের যাত্রার সারসংক্ষেপ
সাত বছর আগের সেই ভীত যুবক থেকে আজকের এই আত্মবিশ্বাসী ব্যবসায়ী—আমার এই যাত্রাটা সহজ ছিল না। এই পথে অনেক বাধা এসেছে, অনেকবার হোঁচট খেয়েছি, কিন্তু কখনো থেমে যাইনি। মরুভূমির বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম, আজ সৃষ্টিকর্তার রহমতে এবং আমার কঠোর পরিশ্রমে তা অনেকটাই বাস্তব। এই যাত্রা আমাকে শুধু আর্থিক সচ্ছলতাই দেয়নি, দিয়েছে আত্মবিশ্বাস, সম্মান এবং প্রতিকূলতাকে জয় করার সাহস।
যদি আপনার চোখেও স্বপ্ন থাকে এবং বুকে থাকে সাহস, তাহলে আপনিও পারবেন। দেশ বা পরিবেশ কোনো বাধাই নয়, যদি আপনার লক্ষ্য স্থির থাকে এবং আপনি সৎ পথে পরিশ্রম করতে রাজি থাকেন। আমার এই গল্প যদি একজন মানুষকেও তার স্বপ্ন পূরণে অনুপ্রাণিত করে, তবেই আমার এই লেখা সার্থক।
সৌদি আরবে ব্যবসা নিয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকলে নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।