রাষ্ট্রীয় ব্যবসা কী? A-Z গাইডলাইন (২০২৫) What is state business? in Bangla A-Z Guide (2025)

রাষ্ট্রীয় ব্যবসা কী? A-Z গাইডলাইন (২০২৫) What is state business? in Bangla A-Z Guide (2025)

Table of Contents

রাষ্ট্রীয় ব্যবসা কী? উদ্দেশ্য, প্রকারভেদ ও পরিচালনার পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ (What is state business? A complete analysis of its purpose, types and management)

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আপনি যে বাতিটি জ্বালান, যে পানি দিয়ে মুখ ধোন, নাশতার জন্য যে গ্যাস বা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে চুলা জ্বালান, অফিসে যাওয়ার জন্য যে পাবলিক বাসে ওঠেন বা মাঝেমধ্যে গ্রামে যাওয়ার জন্য যে ট্রেনে চড়েন—কখনো কি ভেবে দেখেছেন এই অপরিহার্য সেবাগুলো কারা আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে? আমরা যখন বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করি, তখন সেই টাকাটা ঠিক কোথায় যায়? ঢাকা শহরের ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় যখন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজকে আকাশে উড়তে দেখি, তখন কি মনে প্রশ্ন জাগে, এই বিশাল বিমান সংস্থাটির মালিক কে?

এই সব প্রশ্নের উত্তর একটি ধারণার মধ্যে লুকিয়ে আছে, যার সাথে আমরা সবাই পরিচিত, কিন্তু হয়তো এর গভীরতা সম্পর্কে তেমনভাবে জানি না। সেই ধারণাটিই হলো রাষ্ট্রীয় ব্যবসা (State Enterprise)

এককথায়, উপরের সবগুলো প্রতিষ্ঠানই রাষ্ট্রীয় ব্যবসা বা রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগের উদাহরণ। এগুলো কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিগত গোষ্ঠীর মালিকানাধীন নয়; এগুলোর মালিক আপনি, আমি এবং আমরা—অর্থাৎ দেশের সকল জনগণ, আর আমাদের পক্ষ থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করে রাষ্ট্র বা সরকার।

সাধারণত, ব্যবসা বলতে আমরা লাভ-লোকসানের হিসাব, মালিকের ব্যক্তিগত মুনাফা এবং বাজারের কঠিন প্রতিযোগিতার কথাই বুঝি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যবসার জগৎটা এর থেকে অনেকটাই ভিন্ন এবং জটিল। এর উদ্দেশ্য কেবল মুনাফা অর্জন নয়, বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে জনকল্যাণ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় স্বার্থের মতো গুরুগম্ভীর বিষয়।

এই পূর্ণাঙ্গ গাইডটিতে আমরা রাষ্ট্রীয় ব্যবসার এই বিশাল জগৎকে খুব কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করব। আমরা জানব:

  • রাষ্ট্রীয় ব্যবসা ঠিক কী এবং এটি কীভাবে একটি সাধারণ বেসরকারি ব্যবসা থেকে আলাদা?
  • সরকার কেন ব্যবসা করতে আসে? এর পেছনের মূল উদ্দেশ্যগুলো কী?
  • বাংলাদেশে কত ধরনের রাষ্ট্রীয় ব্যবসা রয়েছে এবং তাদের সাংগঠনিক কাঠামো কেমন?
  • এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সুবিধা কী এবং কেনই বা এগুলো প্রায়ই অদক্ষতা বা লোকসানের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়?

চলুন, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।


রাষ্ট্রীয় ব্যবসা কী? (What is a State Enterprise?)

রাষ্ট্রীয় ব্যবসা: A-Z গাইডলাইন (২০২৫)

“ব্যবসা” শব্দটির সাথে “রাষ্ট্র” শব্দটি যুক্ত হলেই এর পুরো অর্থ এবং দর্শন বদলে যায়। এটি তখন আর শুধু একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান থাকে না, বরং হয়ে ওঠে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নীতির এক প্রায়োগিক হাতিয়ার।

সংজ্ঞা ও মূল ধারণা (Definitions and Key Concepts)

সহজ ভাষায়, রাষ্ট্রীয় ব্যবসা হলো এমন একটি ব্যবসায়িক বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে (কমপক্ষে ৫১% মালিকানা) রাষ্ট্রের মালিকানায় গঠিত, পরিচালিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয়।

এই সংজ্ঞাটিকে যদি আমরা আরও সহজ করে বুঝতে চাই, তাহলে একটি তুলনার সাহায্য নিতে পারি। ধরা যাক, একটি বেসরকারি ব্যবসা হলো একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত দোকান। সেই দোকানের লাভ-লোকসানের সকল দায়দায়িত্ব যেমন তার নিজের, তেমনি এর মূল উদ্দেশ্য হলো তার পরিবারের জন্য সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা।

অন্যদিকে, একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবসা হলো একটি দেশের সকল নাগরিকের সম্মিলিত মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। দেশের সরকার জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সেই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে। এর প্রধান উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত মুনাফা নয়, বরং দেশের সকল নাগরিকের (পরিবারের) জন্য অপরিহার্য পণ্য বা সেবা ন্যায্যমূল্যে নিশ্চিত করা। এখানে “শেয়ারহোল্ডার” হলো দেশের আপামর জনসাধারণ।

রাষ্ট্রীয় ব্যবসার জন্ম হয় মূলত দুটি চিন্তা থেকে:

  1. জনকল্যাণ: এমন কিছু মৌলিক সেবা আছে (যেমন: বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা), যা মুনাফার জন্য ব্যক্তিগত খাতের হাতে পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। রাষ্ট্র এখানে সেবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
  2. অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: দেশের কিছু কৌশলগত খাত (যেমন: খনিজ সম্পদ, বন্দর, ভারী শিল্প) রয়েছে, যেগুলোর ওপর জাতীয় নিয়ন্ত্রণ থাকা আবশ্যক। রাষ্ট্র এখানে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে।

বেসরকারি ব্যবসা থেকে এর মৌলিক পার্থক্য (Its fundamental difference from private business)

রাষ্ট্রীয় ব্যবসাকে ভালোভাবে বুঝতে হলে, এর সাথে বেসরকারি ব্যবসার পার্থক্যগুলো स्पष्टভাবে জানা প্রয়োজন।

  • উদ্দেশ্য (Motive): বেসরকারি খাতের মূল চালিকাশক্তি হলো মুনাফা। যে খাতে লাভ নেই, সেখানে বেসরকারি বিনিয়োগও নেই। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় ব্যবসার মূল চালিকাশক্তি হলো জনসেবা বা জনকল্যাণবাস্তব উদাহরণ: ধরুন, ঢাকা থেকে দেশের কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামের বাস রুট আর্থিকভাবে লাভজনক নয়। একজন বেসরকারি বাস মালিক হয়তো কিছুদিন পরেই লোকসানের কারণে সেই রুটে বাস চালানো বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিআরটিসি (BRTC) লোকসান দিয়েও সেই রুটে বাস পরিষেবা চালু রাখতে পারে। কারণ, তার উদ্দেশ্য মুনাফা নয়, বরং সেই প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষকে交通 ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত রাখা।
  • মালিকানা (Ownership): বেসরকারি ব্যবসার মালিক একজন ব্যক্তি (একমালিকানা), কয়েকজন ব্যক্তি (অংশীদারি) বা বহুসংখ্যক শেয়ারহোল্ডার (কোম্পানি) হতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যবসার একমাত্র বা প্রধান মালিক হলো রাষ্ট্র বা সরকার। উদাহরণ: স্কয়ার গ্রুপ বা বেক্সিমকো গ্রুপের মালিকানা ব্যক্তিগত বা শেয়ারহোল্ডারদের। কিন্তু পেট্রোবাংলা বা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের মালিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র, যা পরিচালিত হয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে।
  • ব্যবস্থাপনা (Management): বেসরকারি ব্যবসা সাধারণত এর মালিক বা বেতনভুক্ত পেশাদার ব্যবস্থাপকদের দ্বারা পরিচালিত হয়, যারা সর্বোচ্চ দক্ষতার মাধ্যমে লাভ বাড়ানোর চেষ্টা করেন। রাষ্ট্রীয় ব্যবসার ব্যবস্থাপনা সাধারণত সরকারি কর্মকর্তা বা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একটি পরিচালক পর্ষদের হাতে থাকে। এখানে প্রায়শই পেশাদারিত্বের চেয়ে আমলাতান্ত্রিক নিয়মকানুন বেশি প্রাধান্য পায়।
  • দায়বদ্ধতা (Accountability): একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তার মালিক বা শেয়ারহোল্ডারদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। বছর শেষে লাভের হিসাব বুঝিয়ে দেওয়াই তাদের মূল কাজ। কিন্তু একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দেশের সংসদ এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। এর কার্যক্রম নিয়ে সংসদে আলোচনা হতে পারে, সরকারি অডিট বিভাগ (CAG) এর হিসাব পরীক্ষা করতে পারে এবং গণমাধ্যম এর সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে।

রাষ্ট্রীয় ব্যবসার প্রধান উদ্দেশ্যগুলো (The Main Objectives of State Enterprises)

সরকার কেন ব্যবসা করে—এই প্রশ্নটি খুবই যৌক্তিক। ব্যক্তিগত খাত যেখানে ব্যবসা করতে এত আগ্রহী, সেখানে সরকারের এই ভূমিকা নেওয়ার পেছনে কিছু সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য রয়েছে।

জনকল্যাণ নিশ্চিত করা (Ensuring Public Welfare)

কিছু পণ্য বা সেবা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এতটাই অপরিহার্য যে, সেগুলোকে শুধু মুনাফার весыতে মাপা যায় না। রাষ্ট্র এই সেবাগুলো সকল নাগরিকের কাছে, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে, সুলভ মূল্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেয়। বাস্তব উদাহরণ:

  • স্বাস্থ্যসেবা: একটি বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতালের চিকিৎসার খরচ অনেক সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালগুলো নামমাত্র মূল্যে বা বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। এর উদ্দেশ্য দেশের সকল নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা।
  • পানি সরবরাহ: ঢাকায় ওয়াসা (WASA) যে মূল্যে পানি সরবরাহ করে, একটি বেসরকারি কোম্পানি যদি এই সেবা দিত, তবে মুনাফার জন্য তারা হয়তো এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম ধার্য করত। রাষ্ট্র ভর্তুকি দিয়ে হলেও এই অপরিহার্য সেবাটি সচল রাখে।

সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Balanced Economic Development)

বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা সাধারণত সেই অঞ্চলেই শিল্প স্থাপন করতে চান, যেখানে বিদ্যুৎ, গ্যাস, রাস্তাঘাট এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে (যেমন: ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর)। এর ফলে দেশের কিছু অঞ্চল খুব উন্নত হয়, আর কিছু অঞ্চল অনুন্নতই থেকে যায়। এই আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করতে রাষ্ট্র নিজেই অনুন্নত অঞ্চলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করে। বাস্তব উদাহরণ: স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে শিল্প কারখানা তেমন ছিল না। সরকার যখন সেই অঞ্চলের কৃষকদের কথা ভেবে ঠাকুরগাঁও বা জয়পুরহাটে চিনিকল স্থাপন করলো, তখন শুধু আখ চাষীরাই উপকৃত হয়নি, বরং সেই চিনিকলকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, রাস্তাঘাট উন্নত হয়েছে এবং ছোট-বড় অনেক সহযোগী ব্যবসাও গড়ে উঠেছে। এভাবেই একটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ একটি অনুন্নত অঞ্চলের অর্থনীতির চালচিত্র বদলে দিতে পারে।

ভারী ও কৌশলগত শিল্প স্থাপন (Establishing Heavy & Strategic Industries)

এমন কিছু শিল্প রয়েছে যা একটি দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, কিন্তু সেগুলো প্রতিষ্ঠা করতে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন এবং সেই বিনিয়োগ থেকে লাভ আসতে বহু বছর সময় লেগে যায়। এই বিপুল ঝুঁকি নিতে বেসরকারি খাত সাধারণত এগিয়ে আসে না। বাস্তব উদাহরণ:

  • ইস্পাত শিল্প: একটি দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য লোহা বা ইস্পাত অপরিহার্য। এর জন্য একটি বৃহৎ ইস্পাত কারখানা প্রয়োজন। এই ধরনের প্রকল্পে যে বিপুল বিনিয়োগ ও ঝুঁকি থাকে, তা বেসরকারি খাতের জন্য আকর্ষণীয় নয়। তাই রাষ্ট্রকেই চট্টগ্রাম স্টিল মিলস-এর মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়েছিল।
  • প্রতিরক্ষা শিল্প: দেশের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম তৈরির কারখানা সবসময়ই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। এটি কোনোভাবেই ব্যক্তিগত খাতের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না।

একচেটিয়া ব্যবসা রোধ ও বাজার নিয়ন্ত্রণ (Preventing Monopolies & Market Control)

যদি কোনো একটি অপরিহার্য পণ্যের উৎপাদন বা সরবরাহ কোনো একটি মাত্র বেসরকারি কোম্পানির হাতে থাকে, তবে তারা একটি একচেটিয়া (Monopoly) বাজার তৈরি করে ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের শোষণ করতে পারে। এই পরিস্থিতি রোধ করতে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। বাস্তব উদাহরণ: রমজান মাসের আগে যখন অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজ, চিনি বা তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়, তখন সরকার তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশ (TCB)-এর মাধ্যমে খোলা বাজারে ভর্তুকি মূল্যে এই পণ্যগুলো বিক্রি শুরু করে। এর ফলে বেসরকারি ব্যবসায়ীরা দাম কমাতে বাধ্য হয় এবং বাজার স্থিতিশীল হয়। এখানে TCB লাভ করার জন্য নয়, বরং বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবসা করছে।

রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি (Increasing Revenue & Creating Employment)

জনকল্যাণের পাশাপাশি সরকারের আয়ের একটি বড় উৎস হতে পারে রাষ্ট্রীয় ব্যবসা। লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ সরকারের কোষাগারে জমা হয়, যা রাস্তা, সেতু, স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদি নির্মাণে ব্যয় করা হয়। উদাহরণ:

  • রাজস্ব আয়: তিতাস গ্যাস বা অন্যান্য লাভজনক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি বছর সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বা লভ্যাংশ প্রদান করে।
  • কর্মসংস্থান: বাংলাদেশ রেলওয়ে, সোনালী ব্যাংক বা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের অন্যতম বৃহৎ নিয়োগকারী সংস্থা। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মরত আছেন, যা দেশের বেকার সমস্যা কমাতে বিশাল ভূমিকা রাখে।

রাষ্ট্রীয় ব্যবসার বৈশিষ্ট্য (Features of State Enterprises)

রাষ্ট্রীয় ব্যবসাকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা করার জন্য এর কিছু মৌলিক ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোই এর চরিত্র, কার্যক্রম এবং পরিচালনার ধরণ নির্ধারণ করে দেয়।

রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ (State Ownership and Control)

এটি রাষ্ট্রীয় ব্যবসার প্রথম এবং প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ বা ಬಹುಪಾಲು মূলধন (কমপক্ষে ৫১% শেয়ার) সরকার সরবরাহ করে। এই অর্থ আসে জনগণের দেওয়া কর বা সরকারি কোষাগার থেকে। যেহেতু মালিকানা রাষ্ট্রের, তাই এর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণও সরকারের হাতেই থাকে। সরকার সাধারণত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বা সরাসরি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্ষদে সরকার তার প্রতিনিধি নিয়োগ করে এবং তারাই প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারণ ও দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করে।

সেবামূলক উদ্দেশ্য (Service Motive)

আগেই বলা হয়েছে, মুনাফা অর্জন রাষ্ট্রীয় ব্যবসার মূল লক্ষ্য হলেও, এর চেয়েও বড় উদ্দেশ্য হলো জনসেবা নিশ্চিত করা। এই সেবামূলক উদ্দেশ্যের কারণেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনেক সময় লোকসান দিয়েও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হয়। বাস্তব উদাহরণ: বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দেশের এমন সব প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলে চিঠিপত্র ও পার্সেল সেবা পৌঁছে দেয়, যেখানে কোনো বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিস লাভজনক না হওয়ায় তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে না। এখানে ডাক বিভাগের উদ্দেশ্য মুনাফা নয়, বরং দেশের প্রতিটি নাগরিককে যোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায় আনা, যা একটি মৌলিক সেবা।

জনসাধারণের কাছে দায়বদ্ধতা (Public Accountability)

যেহেতু রাষ্ট্রীয় ব্যবসার মালিক দেশের জনগণ এবং এর মূলধন জনগণের অর্থায়নে গঠিত, তাই এই প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। এই দায়বদ্ধতা বিভিন্ন উপায়ে নিশ্চিত করা হয়। যেমন:

  • প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে তার বার্ষিক প্রতিবেদন এবং হিসাব-নিকাশ সংসদের কাছে উপস্থাপন করতে হয়।
  • সংসদীয় কমিটিগুলো এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতে পারে।
  • সরকারের নিয়ন্ত্রক ও মহাহিসাব নিরীক্ষক (Comptroller and Auditor General – CAG) প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব নিরীক্ষা করে থাকে।
  • গণমাধ্যম এবং দেশের সচেতন নাগরিকরাও এদের কার্যক্রমের ওপর নজর রাখে এবং সমালোচনা করতে পারে। এই প্রকাশ্য জবাবদিহিতা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় না।

আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা (Bureaucratic Management)

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত সরকারি কর্মকর্তা বা আমলাদের দ্বারা পরিচালিত হয়। এর কার্যক্রম পরিচালিত হয় কঠোর নিয়মকানুন, বিধি এবং পদ্ধতির শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকে। এই আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার একটি ভালো দিক হলো, এটি কাজে স্বচ্ছতা এবং নিয়মানুবর্তিতা নিশ্চিত করে। কিন্তু এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে। এই ব্যবস্থার কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে মারাত্মক বিলম্ব ঘটে, যা ‘লাল ফিতার দৌরাত্ম্য’ (Red Tapism) নামে পরিচিত। এছাড়া, কর্মকর্তাদের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে নতুন কিছু করার উদ্যোগ কমে যায়।


রাষ্ট্রীয় ব্যবসার প্রকারভেদ বা সাংগঠনিক কাঠামো (Types or Organizational Structures of State Enterprises)

রাষ্ট্রীয় ব্যবসাগুলো তাদের গঠন, নিয়ন্ত্রণ এবং স্বায়ত্তশাসনের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে মূলত তিন ধরনের সাংগঠনিক কাঠামোতে পরিচালিত হয়।

বিভাগীয় সংগঠন (Departmental Undertaking)

এটি রাষ্ট্রীয় ব্যবসার সবচেয়ে পুরোনো এবং সনাতনী রূপ। এক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠানটি সরকারের কোনো নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের একটি অংশ হিসেবে সরাসরি পরিচালিত হয়। এর কোনো আলাদা আইনি সত্তা থাকে না এবং এটি মন্ত্রণালয়ের নিয়মকানুন দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।

  • উদাহরণ: বাংলাদেশ রেলওয়ে (রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে), ডাক বিভাগ (ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে)।
  • বিশ্লেষণ: বাংলাদেশ রেলওয়ের বাজেট সরাসরি জাতীয় বাজেটের অংশ হিসেবে পাস হয়। এর সকল আয় সরকারি কোষাগারে জমা হয় এবং সকল ব্যয়ও সেখান থেকেই নির্বাহ করা হয়। রেলওয়ের কর্মচারীরা সরকারি কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হন এবং তাদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও চাকরির শর্তাবলী সরকারি চাকরি বিধিমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এর সুবিধা হলো, সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকায় এখানে আর্থিক নয়ছয়ের সুযোগ কম থাকে। কিন্তু অসুবিধা হলো, সামান্য একটি সিদ্ধান্ত নিতেও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়, যা এর দক্ষতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে।

রাষ্ট্রীয় বা বিধিবদ্ধ কর্পোরেশন (Statutory Corporation)

এই ধরনের প্রতিষ্ঠান সংসদের একটি বিশেষ আইন বা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে গঠিত হয়। এই আইনটিতেই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য, ক্ষমতা, কার্যপরিধি এবং পরিচালনার নিয়মাবলী স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। এর একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র আইনি সত্তা থাকে।

  • উদাহরণ: ঢাকা ওয়াসা (Dhaka WASA), বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (BPDB), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন (BIWTC)।
  • বিশ্লেষণ: ঢাকা ওয়াসা একটি নির্দিষ্ট ‘ওয়াসা আইন’ দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত। এটি সরকারি মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে একটি নিজস্ব পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এর নিজস্ব তহবিল থাকে এবং এটি স্বাধীনভাবে আয়-ব্যয় করতে পারে। এই কাঠামোটি বিভাগীয় সংগঠনের চেয়ে বেশি স্বায়ত্তশাসন এবং পরিচালনাগত স্বাধীনতা ভোগ করে। এর ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গতি আসে। তবে এর অসুবিধা হলো, যে আইন দ্বারা এটি গঠিত, সেই আইন পরিবর্তন করা বেশ কঠিন ও সময়সাপেক্ষ, যা পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বাধা সৃষ্টি করে।

সরকারি কোম্পানি (Government Company)

এটি রাষ্ট্রীয় ব্যবসার সবচেয়ে আধুনিক এবং নমনীয় রূপ। এক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠানটি দেশের প্রচলিত কোম্পানি আইন (বাংলাদেশে ‘কোম্পানি আইন, ১৯৯৪’) অনুযায়ী একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। শর্ত হলো, এই কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের কমপক্ষে ৫১% শেয়ার সরকারের মালিকানায় থাকতে হবে।

  • উদাহরণ: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, সোনালী ব্যাংক পিএলসি
  • বিশ্লেষণ: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স একটি লিমিটেড কোম্পানি। এর নিজস্ব স্মারকলিপি (Memorandum) ও পরিমেল নিয়মাবলী (Articles) রয়েছে এবং এটি একটি পরিচালক পর্ষদ দ্বারা পরিচালিত হয়। এটি একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সের মতোই স্বাধীনভাবে ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কর্মী নিয়োগ করতে পারে এবং নতুন রুট চালু করতে পারে। এই কাঠামোটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি খাতের সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্য প্রয়োজনীয় নমনীয়তা এবং স্বাধীনতা প্রদান করে। তবে এর একটি সম্ভাব্য অসুবিধা হলো, অনেক সময় কোম্পানির কাঠামো অনুসরণ করতে গিয়ে এর জনকল্যাণমূলক উদ্দেশ্যটি গৌণ হয়ে পড়ে এবং এটি মুনাফা অর্জনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়তে পারে।

 

রাষ্ট্রীয় ব্যবসার সুবিধা ও অসুবিধা (Advantages and Disadvantages)

যেকোনো অর্থনৈতিক মডেলের মতোই রাষ্ট্রীয় ব্যবসারও কিছু শক্তিশালী দিক এবং কিছু দুর্বল দিক রয়েছে।

 সুবিধাসমূহ (The Advantages)

  • কৌশলগত খাতের ওপর জাতীয় নিয়ন্ত্রণ: দেশের তেল, গ্যাস, বন্দর, প্রতিরক্ষা শিল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো জাতীয় নিয়ন্ত্রণে থাকে, যা দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
  • জনকল্যাণকে প্রাধান্য: লাভজনক নয় এমন কিন্তু জরুরি সেবাগুলো (যেমন: প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিবহন বা বিদ্যুৎ) চালু রাখার মাধ্যমে রাষ্ট্র তার জনকল্যাণমূলক দায়িত্ব পালন করে।
  • সুষম উন্নয়ন: অনুন্নত অঞ্চলে শিল্প স্থাপন করে আঞ্চলিক বৈষম্য কমায় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।
  • শ্রমিকের স্বার্থরক্ষা: রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তা, বেতন কাঠামো এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা (যেমন: পেনশন, আবাসন) বেসরকারি খাতের তুলনায় অনেক বেশি সুরক্ষিত থাকে।

অসুবিধাসমূহ (The Disadvantages)

  • আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্য: সিদ্ধান্ত গ্রহণে অহেতুক বিলম্ব হয়। একটি নতুন যন্ত্র কেনার জন্য যে ফাইলওয়ার্ক শুরু হয়, তা হয়তো চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে পেতে যন্ত্রটির প্রযুক্তিই পুরোনো হয়ে যায়। এই দীর্ঘসূত্রতা প্রতিষ্ঠানকে অচল করে দেয়।
  • রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ: প্রায়শই অযোগ্য এবং দলীয় ব্যক্তিদের রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া, অনেক সময় populism বা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য অর্থনৈতিকভাবে অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হয়, যেমন—উৎপাদন খরচ বাড়লেও ভোটের রাজনীতির কারণে বিদ্যুতের দাম না বাড়ানো।
  • অদক্ষতা, দুর্নীতি ও লোকসান: প্রতিযোগিতার অভাব, চাকরির অতিরিক্ত নিরাপত্তা এবং জবাবদিহিতার দুর্বলতার কারণে কর্মীদের মধ্যে কাজে অনীহা ও অদক্ষতা তৈরি হয়। এর ফলে, প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়শই লোকসানের বোঝায় পরিণত হয় এবং জনগণের করের টাকায় তাদের টিকিয়ে রাখতে হয়।
  • উদ্যোগ ও সৃজনশীলতার অভাব: সরকারি চাকরির কঠোর নিয়ম এবং ভুলের জন্য জবাবদিহিতার ভয়ে কর্মকর্তারা ঝুঁকি নিতে বা নতুন কোনো উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ করতে ভয় পান। তারা কেবল নিয়মমাফিক কাজ করে দায়িত্ব শেষ করতে চান, যা প্রতিষ্ঠানকে স্থবির করে রাখে।

অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় ব্যবসার ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ (The role and future of state-owned businesses in the economy)

রাষ্ট্রীয় ব্যবসা: A-Z গাইডলাইন (২০২৫)

উন্নয়নশীল দেশে রাষ্ট্রীয় ব্যবসার গুরুত্ব

বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় ব্যবসার একটি ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে, স্বাধীনতার পর যখন দেশে বেসরকারি উদ্যোক্তা এবং পুঁজির বিশাল অভাব ছিল, তখন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগই শিল্পায়নের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, টেলিফোন থেকে শুরু করে সার ও চিনির কারখানা—এই সবকিছুই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল, যার ওপর ভিত্তি করে আজকের বেসরকারি খাত বিকশিত হয়েছে।

বেসরকারিকরণ ও পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP)

বিশ্বায়নের এই যুগে অদক্ষ এবং লোকসানি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনীতির জন্য একটি বোঝায় পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য গত কয়েক দশক ধরে বিশ্বজুড়ে বেসরকারিকরণ (Privatization)-এর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর অর্থ হলো, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিগত খাতের কাছে বিক্রি করে দেওয়া, যাতে এটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে দক্ষতার সাথে চলতে পারে।

তবে, বর্তমানে বেসরকারিকরণের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হলো পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) বা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মডেল। এটি একটি হাইব্রিড ব্যবস্থা, যেখানে কোনো বড় প্রকল্পে (যেমন: একটি সেতু, মেট্রো রেল বা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ) সরকার এবং বেসরকারি খাত একসাথে কাজ করে। এখানে সরকার জমি অধিগ্রহণ এবং নীতিগত সহায়তা প্রদান করে, আর বেসরকারি খাত তার পুঁজি, প্রযুক্তি এবং ব্যবস্থাপনা দক্ষতা নিয়ে আসে। বাংলাদেশের পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদি PPP মডেলের সফল উদাহরণ। এই মডেলটি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং বেসরকারি দক্ষতার একটি চমৎকার সমন্বয় ঘটায়।


প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

  • প্রশ্ন ১: সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানই কি রাষ্ট্রীয় ব্যবসা?
    • উত্তর: না। যে সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং আয়-ব্যয়ের সাথে জড়িত, কেবল সেগুলোই রাষ্ট্রীয় ব্যবসা। যেমন: সচিবালয় একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, কিন্তু এটি ব্যবসা নয়। কিন্তু সোনালী ব্যাংক একটি সরকারি মালিকানাধীন ব্যবসা।
  • প্রশ্ন ২: রাষ্ট্রীয় কর্পোরেশন এবং সরকারি কোম্পানির মধ্যে মূল পার্থক্য কী?
    • উত্তর: রাষ্ট্রীয় কর্পোরেশন সংসদের একটি বিশেষ আইন দ্বারা গঠিত হয় এবং এর কার্যক্রম সেই আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে, সরকারি কোম্পানি দেশের সাধারণ কোম্পানি আইন দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত হয়, যেখানে সরকারের ৫১% বা তার বেশি শেয়ার থাকে।
  • প্রশ্ন ৩: রাষ্ট্রীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই লোকসানে চলে কেন?
    • উত্তর: এর প্রধান কারণগুলো হলো—রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাপনা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ এবং জনকল্যাণমূলক উদ্দেশ্য পূরণ করতে গিয়ে লোকসানে সেবা প্রদান।
  • প্রশ্ন ৪: বেসরকারিকরণ (Privatization) বলতে কী বোঝায়?
    • উত্তর: বেসরকারিকরণ হলো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বা ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বেসরকারি খাতের কাছে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া।

উপসংহার: পরিবর্তনশীল বিশ্বে রাষ্ট্রীয় ব্যবসার প্রাসঙ্গিকতা

রাষ্ট্রীয় ব্যবসা একটি দেশের অর্থনীতিতে দ্বৈত ভূমিকা পালন করে—এটি একদিকে যেমন একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, অন্যদিকে তেমনি রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়নের একটি হাতিয়ার। এর জন্ম হয়েছিল জনকল্যাণ এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভিত্তি স্থাপনে, এটি সফলও হয়েছে।

কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে রাষ্ট্রীয় ব্যবসার সনাতনী ধারণাটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অদক্ষতা, লোকসান আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার পুরনো অভিযোগগুলো থেকে বেরিয়ে এসে তাকে নতুন রূপে আবির্ভূত হতে হচ্ছে।

ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ব্যবসার প্রাসঙ্গিকতা নির্ভর করবে এর সংস্কার এবং অভিযোজনের ক্ষমতার ওপর। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত পেশাদার ব্যবস্থাপনা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং স্বচ্ছ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই কেবল এই প্রতিষ্ঠানগুলো যুগোপযোগী হয়ে উঠতে পারে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মতো উদ্ভাবনী মডেলগুলো হয়তো এই যাত্রায় নতুন পথের দিশা দেখাবে। চূড়ান্তভাবে, যে রাষ্ট্রীয় ব্যবসা তার বাণিজ্যিক দক্ষতার সাথে জনকল্যাণের উদ্দেশ্যকে সফলভাবে সমন্বয় করতে পারবে, সেটিই পরিবর্তনশীল বিশ্বে নিজের অস্তিত্বের ন্যায্যতা প্রমাণ করতে সক্ষম হবে।

Leave a Comment

সম্পর্কিত পোস্টসমূহ

আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

Scroll to Top