টমাস আলভা এডিসন Thomas Alva Edison উদ্ভাবক থেকে সফল ব্যবসায়ী হওয়ার গল্প

টমাস আলভা এডিসন Thomas Alva Edison উদ্ভাবক থেকে সফল ব্যবসায়ী হওয়ার গল্প

Table of Contents

টমাস আলভা এডিসন Thomas Alva Edison উদ্ভাবক থেকে সফল ব্যবসায়ী হওয়ার গল্প

কখনো কি ভেবে দেখেছেন, বৈদ্যুতিক বাতি ছাড়া আমাদের আধুনিক বিশ্ব কেমন হতো? রাতের অন্ধকার শেষে দিনের আলোর জন্য অপেক্ষা করা, মোমবাতি বা কেরোসিনের বাতির মৃদু আলোয় পড়াশোনা করা, কিংবা শিল্পকারখানা দিনের বেলাতেই বন্ধ হয়ে যাওয়া—এমন একটি পৃথিবী কল্পনা করাও আজ আমাদের জন্য কঠিন। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন একজন মানুষ, যার নাম টমাস আলভা এডিসন। কিন্তু তাকে শুধু বৈদ্যুতিক বাতির উদ্ভাবক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলে তার প্রতিভার এক ভগ্নাংশই কেবল বলা হয়।

এডিসন ছিলেন একজন স্বপ্নদর্শী, একজন দূরদর্শী ব্যবসায়ী এবং একজন মার্কেটিং জিনিয়াস, যিনি জানতেন কীভাবে একটি পরীক্ষাগারের ধারণাকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হয়। তিনি কেবল উদ্ভাবন করেননি, উদ্ভাবনকে শিল্পে পরিণত করেছিলেন। এই পোস্টে আমরা টমাস আলভা এডিসনের সেই অসাধারণ যাত্রাপথকেই অন্বেষণ করব, যেখানে তার উদ্ভাবনী প্রতিভা এবং ব্যবসায়িক দূরদর্শিতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল এবং তাকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রেখেছে।

প্রারম্ভিক জীবন ও অনুপ্রেরণা: সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প

প্রতিটি महान মানুষের পেছনেই থাকে অনুপ্রেরণার এক অসাধারণ গল্প। টমাস এডিসনের জীবনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তার শৈশবের প্রতিকূলতা এবং কৈশোরের অভিজ্ঞতাগুলোই তাকে未来的 “মেনলো পার্কের জাদুকর” হিসেবে গড়ে তুলেছিল।

শৈশব ও প্রতিকূলতা: শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা যখন আশীর্বাদ

১৮৪৭ সালে ওহাইওর মিলানে জন্মগ্রহণ করেন টমাস আলভা এডিসন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ভীষণ কৌতূহলী, কিন্তু প্রথাগত পড়াশোনায় তার মোটেও মন বসত না। তার শিক্ষকরা তাকে ” অমনোযোগী” এবং “কিছু শিখতে অক্ষম” বলে মনে করতেন। মাত্র তিন মাস স্কুলে যাওয়ার পর তার মা, ন্যান্সি এডিসন, তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনেন। তিনি নিজেই একজন প্রাক্তন শিক্ষিকা ছিলেন এবং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তার ছেলের শেখার ধরণটা অন্যদের চেয়ে আলাদা। এরপর থেকে ঘরেই শুরু হয় এডিসনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।

শৈশবে স্কারলেট ফিভারে আক্রান্ত হওয়ার কারণে এডিসনের শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি প্রায় বধির হয়ে যান। কিন্তু এই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তার জন্য শাপে বর হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী জীবনে এডিসন বলেছিলেন, কানে কম শোনার কারণে তিনি বাইরের কোলাহল থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারতেন এবং নিজের কাজে গভীরভাবে মনোযোগ দিতে পারতেন। যা অন্যরা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখেছিল, এডিসন তাকে তার সাফল্যের অন্যতম হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন। তার মায়ের বিশ্বাস এবং নিজের একাগ্রতা তাকে গতানুগতিক শিক্ষার বাইরে চিন্তা করতে শিখিয়েছিল।

প্রথমদিকের কাজ এবং টেলিগ্রাফ অপারেটর জীবন

মাত্র ১২ বছর বয়সে এডিসন বাড়ির কাছাকাছি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রেললাইনে সংবাদপত্র এবং ক্যান্ডি বিক্রি করার কাজ শুরু করেন। কিন্তু তিনি শুধু একজন সাধারণ হকার ছিলেন না। তার উদ্যোক্তা মন তাকে দিয়ে ট্রেনের একটি মালগাড়ির কামরায় একটি ছোট ছাপাখানা বসিয়েছিল, যেখান থেকে তিনি “দ্য গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক হেরাল্ড” নামে নিজের পত্রিকা ছাপাতেন। এমনকি সেই কামরাতেই তিনি একটি ছোট রাসায়নিক গবেষণাগারও তৈরি করেছিলেন।

তার জীবনের মোড় ঘুরে যায় যখন তিনি রেললাইনের ওপর আটকে পড়া একটি তিন বছরের শিশুকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচান। শিশুটির বাবা, যিনি ছিলেন একজন স্টেশন এজেন্ট, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এডিসনকে টেলিগ্রাফ অপারেটরের কাজ শিখিয়ে দেন। পরবর্তী পাঁচ বছর এডিসন আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে টেলিগ্রাফ অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। এই চাকরিটি ছিল তার জন্য একটি জীবন্ত বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি দিনরাত বৈদ্যুতিক সংকেত এবং টেলিগ্রাফ যন্ত্রের খুঁটিনাটি নিয়ে গবেষণা করতেন। এই সময়েই তিনি তার প্রথম দিকের উদ্ভাবনগুলোর প্রচেষ্টা শুরু করেন, যার মধ্যে ছিল একটি উন্নত স্টক টিকার, যা শেয়ার বাজারের তথ্য দ্রুত পাঠাতে পারত। এই অভিজ্ঞতাগুলোই তার ভবিষ্যত উদ্ভাবনী জীবনের শক্ত ভিত্তি স্থাপন করে দিয়েছিল।

মেনলো পার্কের জাদুকর: উদ্ভাবনের এক কারখানা

টেলিগ্রাফ অপারেটরের জীবন শেষে এডিসন তার সমস্ত মনোযোগ উদ্ভাবনের জগতে নিবদ্ধ করেন। ১৮৭৬ সালে, নিউ জার্সির মেনলো পার্কে তিনি একটি গবেষণাগার স্থাপন করেন, যা কেবল একটি সাধারণ ল্যাব ছিল না; এটি ছিল বিশ্বের প্রথম “উদ্ভাবনী কারখানা”। এখানেই এডিসন এবং তার দলবদ্ধ গবেষকরা पद्धতিগতভাবে একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার করে পৃথিবীকে চমকে দিয়েছিলেন। আর এই ল্যাবই তাকে এনে দিয়েছিল “মেনলো পার্কের জাদুকর” (The Wizard of Menlo Park) খেতাব।

ফোনোগ্রাফ: যে যন্ত্র কথা বলত

মেনলো পার্কে এডিসনের প্রথম বড় আবিষ্কারটি ছিল ফোনোগ্রাফ। ১৮৭৭ সালে তিনি এমন একটি যন্ত্র তৈরি করেন যা শব্দ রেকর্ড করতে এবং পুনরায় চালাতে পারত। যখন তিনি প্রথমবার যন্ত্রটিতে “Mary had a little lamb” নার্সারি ছড়াটি রেকর্ড করে আবার শোনালেন, তখন তার সহকর্মীরাসহ পুরো বিশ্ব বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। একটি যন্ত্র মানুষের কণ্ঠস্বর ধারণ করে আবার শোনাচ্ছে—এই ধারণাটিই ছিল সেই সময়ের জন্য এককথায় জাদু। ফোনোগ্রাফের আবিষ্কার এডিসনকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। খবরের কাগজগুলো তাকে নিয়ে প্রশংসার ঝড় বইয়ে দেয় এবং সাধারণ মানুষ তাকে একজন সত্যিকারের জাদুকর হিসেবে দেখতে শুরু করে।

বৈদ্যুতিক বাতি: পৃথিবীকে আলোকিত করার সেই দীর্ঘ মিশন

এডিসনের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী আবিষ্কার হলো বাণিজ্যিকভাবে সফল বৈদ্যুতিক বাতি। যদিও তার আগে অনেকেই বৈদ্যুতিক আলোর ধারণা নিয়ে কাজ করেছিলেন, কিন্তু কেউই এমন একটি বাতি তৈরি করতে পারেননি যা দীর্ঘস্থায়ী, নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী হবে। এডিসন এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেন। তিনি এমন একটি ফিলামেন্ট বা তারের সন্ধান করছিলেন যা বিদ্যুতের প্রবাহে জ্বলে উঠবে কিন্তু দ্রুত পুড়ে যাবে না।

এই লক্ষ্যে তিনি এবং তার দল হাজার হাজার বিভিন্ন উপাদান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তুলা, কাঠ, কাগজ থেকে শুরু করে মানুষের চুল পর্যন্ত—কিছুই বাদ যায়নি। বারবার ব্যর্থতার পর অবশেষে তারা কার্বনাইজড বাঁশের আঁশ (Carbonized bamboo filament) দিয়ে তৈরি ফিলামেন্টে সাফল্য পান, যা প্রায় ১২০০ ঘণ্টা পর্যন্ত জ্বলতে সক্ষম ছিল। এই কঠোর পরিশ্রমের কথাই তিনি তার বিখ্যাত উক্তিতে তুলে ধরেছিলেন: “আমি ১,০০০ বার ব্যর্থ হইনি, আমি কেবল ১,০০০টি উপায় খুঁজে বের করেছি যা কাজ করবে না।” ১৮৭৯ সালে তার এই আবিষ্কারটি মানব সভ্যতাকে রাতের অন্ধকার থেকে মুক্ত করে এক নতুন আলোকিত যুগে প্রবেশ করায়।

বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা: একটি বিপ্লবী ব্যবসায়িক মডেল

টমাস এডিসনের প্রতিভা শুধু একটি বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাতিটি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হলে একটি সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণ ব্যবস্থার প্রয়োজন। এটি ছিল তার ব্যবসায়িক দূরদর্শিতার চূড়ান্ত নিদর্শন।

তিনি ডাইরেক্ট কারেন্ট (ডিসি) ব্যবহার করে একটি বিদ্যুৎ গ্রিড তৈরির পরিকল্পনা করেন। এই সিস্টেমের অধীনে ছিল জেনারেটর, ভূগর্ভস্থ তার, ফিউজ, সুইচ এবং মিটার। ১৮৮২ সালে, নিউইয়র্কের পার্ল স্ট্রিট স্টেশনে তিনি বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেন এবং ম্যানহাটনের একটি ছোট অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেন। এটি ছিল একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ যা আধুনিক বিদ্যুৎ শিল্পের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। শুধু একটি পণ্য নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ পরিষেবা তৈরি করে এডিসন প্রমাণ করেছিলেন যে তিনি একজন উদ্ভাবকের চেয়েও অনেক বেশি কিছু।

উদ্ভাবক থেকে উদ্যোক্তা: এডিসনের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য

মেনলো পার্কের সাফল্য এডিসনকে শিখিয়েছিল যে একটি ভালো ধারণা যথেষ্ট নয়, সেই ধারণাকে বাজারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি শক্তিশালী ব্যবসায়িক কাঠামো প্রয়োজন। তিনি তার উদ্ভাবনগুলোকে কেন্দ্র করে এমন এক বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন, যা আজও বিশ্বের বড় বড় কর্পোরেশনগুলোকে অনুপ্রেরণা জোগায়।

পেটেন্ট এবং তার কৌশলগত ব্যবহার

এডিসন খুব ভালোভাবেই বুঝতেন যে উদ্ভাবনের প্রকৃত মূল্য তার বাণিজ্যিকীকরণের মধ্যেই নিহিত। আর এর জন্য সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল পেটেন্ট। তার নামে মোট ১,০৯৩টি মার্কিন পেটেন্ট নথিভুক্ত রয়েছে, যা আজও একজন একক ব্যক্তির জন্য একটি রেকর্ড। কিন্তু তিনি শুধু পেটেন্টের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কাজ করেননি; তিনি পেটেন্টকে একটি ব্যবসায়িক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতেন। প্রতিটি আবিষ্কারের পর তিনি দ্রুততম সময়ে পেটেন্ট আবেদন করতেন, যা তাকে আইনি সুরক্ষা দিত এবং প্রতিযোগীদের থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে রাখত। তিনি তার পেটেন্ট করা প্রযুক্তি অন্য কোম্পানিকে লাইসেন্স দিতেন, যা তার জন্য একটি বিশাল রাজস্বের উৎস হয়ে উঠেছিল। এভাবেই তিনি উদ্ভাবনকে একটি লাভজনক ব্যবসায়িক মডেলে রূপান্তরিত করেছিলেন।

জেনারেল ইলেকট্রিক (General Electric) প্রতিষ্ঠা: একটি উত্তরাধিকার নির্মাণ

১৮৮০-এর দশকের শেষের দিকে এডিসন তার বিদ্যুৎ-সম্পর্কিত সমস্ত ব্যবসায়িক উদ্যোগকে একত্রিত করে “এডিসন জেনারেল ইলেকট্রিক” নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু বাজারের চাহিদা এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে তিনি তার প্রধান প্রতিযোগী “থমসন-হাউস্টন ইলেকট্রিক কোম্পানি”-র সাথে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৯২ সালে এই দুই কোম্পানির विलयের মাধ্যমে জন্ম হয় “জেনারেল ইলেকট্রিক” বা GE-র, যা আজও বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এবং প্রভাবশালী বহুজাতিক কোম্পানি। GE প্রতিষ্ঠা ছিল এডিসনের ব্যবসায়িক জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। এটি প্রমাণ করে যে তিনি কেবল একজন উদ্ভাবকই ছিলেন না, বরং একজন বাস্তববাদী ব্যবসায়ীও ছিলেন, যিনি বাজারের গতিপ্রকৃতি বুঝতেন এবং নিজের ব্যক্তিগত অহংকারকে দূরে সরিয়ে রেখে বড় লক্ষ্য অর্জনের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।

বিপণন ও জনসংযোগের জাদুকর

এডিসন ছিলেন একজন সহজাত মার্কেটিং গুরু। তিনি জানতেন কীভাবে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে মানুষের মনে তার আবিষ্কার সম্পর্কে আগ্রহ এবং আস্থা তৈরি করতে হয়। বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের পর তিনি সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে জনসমক্ষে তার কার্যকারিতা প্রদর্শন করেন। তিনি তার মেনলো পার্ক ল্যাবকে এমনভাবে ব্র্যান্ডিং করেছিলেন যে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে সেখান থেকে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। তিনি বিনিয়োগকারী এবং সাধারণ মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে তার প্রযুক্তি কেবল পরীক্ষাগারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এটি তাদের দৈনন্দিন জীবনকে বদলে দেবে। এই অসাধারণ বিপণন দক্ষতাই তাকে অন্য উদ্ভাবকদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল।

এডিসনের দর্শন: ব্যর্থতা এবং কঠোর পরিশ্রমের নীতি

এডিসনের সাফল্যের পেছনে শুধু তার মেধা বা ব্যবসায়িক বুদ্ধিই ছিল না, ছিল তার জীবনদর্শন—যা কঠোর পরিশ্রম এবং ব্যর্থতাকে আলিঙ্গন করার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।

“এক শতাংশ অনুপ্রেরণা এবং নিরানব্বই শতাংশ কঠোর পরিশ্রম”

“প্রতিভা হলো এক শতাংশ অনুপ্রেরণা এবং নিরানব্বই শতাংশ কঠোর পরিশ্রম” (“Genius is one percent inspiration and ninety-nine percent perspiration”)—এডিসনের এই বিখ্যাত উক্তিটি তার কর্মজীবনের মূলমন্ত্র ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মহান ধারণাগুলো অলস মস্তিষ্কে জন্মায় না, বরং এর জন্য প্রয়োজন অবিরাম প্রচেষ্টা এবং অধ্যবসায়। তিনি এবং তার দলের সদস্যরা প্রায়ই দিনরাত এক করে কাজ করতেন। শোনা যায়, বৈদ্যুতিক বাতির ফিলামেন্ট নিয়ে কাজ করার সময় তিনি টানা ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে জেগে ছিলেন। তার কাছে কাজই ছিল জীবন, আর জীবনই ছিল কাজ। এই কঠোর পরিশ্রমই তার অসাধারণ সাফল্যের মূল ভিত্তি ছিল।

ব্যর্থতাকে সাফল্যের সোপান হিসেবে দেখা

আমাদের বেশিরভাগ মানুষই ব্যর্থতাকে ভয় পায়। কিন্তু এডিসনের কাছে প্রতিটি ব্যর্থতা ছিল সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার একটি নতুন ধাপ। তিনি তার হাজারো অসফল পরীক্ষাকে ব্যর্থতা হিসেবে দেখেননি, বরং সেগুলোকে শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, প্রতিটি ভুল প্রচেষ্টা তাকে সঠিক পথের আরও কাছে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যর্থতার প্রতি এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই তাকে বছরের পর বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার মানসিক শক্তি জুগিয়েছিল। তার এই দর্শন আজকের বিশ্বের উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবকদের জন্য এক অমূল্য পাথেয়।

সমালোচনা ও বিতর্ক: মুদ্রার অপর পিঠ

এত অসাধারণ সাফল্য সত্ত্বেও টমাস এডিসনের জীবন বিতর্ক থেকে মুক্ত ছিল না। তার কিছু ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত এবং একগুঁয়েমি তাকে সমালোচনার পাত্রে পরিণত করেছিল, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো “কারেন্টের যুদ্ধ”।

নিকোলা টেসলার সাথে দ্বন্দ্ব: কারেন্টের যুদ্ধ (War of Currents)

১৮৮০-এর দশকের শেষের দিকে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা নিয়ে এক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। এডিসন তার ডাইরেক্ট কারেন্ট (DC) সিস্টেমের পক্ষে ছিলেন, যা ছিল তুলনামূলকভাবে নিরাপদ কিন্তু বেশি দূরত্বে বিদ্যুৎ পরিবহনে অক্ষম। অন্যদিকে, তার প্রাক্তন কর্মচারী এবং মেধাবী উদ্ভাবক নিকোলা টেসলা অল্টারনেটিং কারেন্ট (AC) সিস্টেমের প্রস্তাব করেন, যা উচ্চ ভোল্টেজে বহুদূর পর্যন্ত বিদ্যুৎ পাঠাতে পারত।

নিজের DC সিস্টেমের বাজার রক্ষা করতে এডিসন এক আগ্রাসী প্রচারণায় নামেন। তিনি AC কারেন্টকে “বিপজ্জনক” এবং “প্রাণঘাতী” হিসেবে প্রমাণ করার জন্য জনসমক্ষে কুকুর এবং বিড়ালের মতো প্রাণী বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে হত্যা করেন। এমনকি প্রথম বৈদ্যুতিক চেয়ার তৈরিতেও তিনি AC জেনারেটর ব্যবহারের পরামর্শ দেন, যাতে মানুষের মনে AC সম্পর্কে ভয় জন্মায়। যদিও শেষ পর্যন্ত টেসলার AC সিস্টেমই তার কার্যকারিতার জন্য জয়লাভ করে এবং আজকের বিশ্বের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ভিত্তি হয়ে ওঠে, কিন্তু এই “কারেন্টের যুদ্ধ” এডিসনের ভাবমূর্তিতে একটি কালো দাগ রেখে যায়। এটি দেখায় যে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় তিনি কতটা কঠোর এবং নির্মম হতে পারতেন।

উপসংহার: টমাস এডিসনের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার

টমাস আলভা এডিসন কেবল একজন ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে কৌতূহল, কঠোর পরিশ্রম এবং ব্যবসায়িক দূরদর্শিতার সমন্বয়ে পৃথিবীকে বদলে দেওয়া যায়। ফোনোগ্রাফ থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক বাতি এবং চলচ্চিত্র ক্যামেরা—তার একেকটি আবিষ্কার মানব সভ্যতার গতিপথকে নতুন দিকে চালিত করেছে।

তিনি শুধু ১,০৯৩টি পেটেন্টের মালিকই নন, তিনি আধুনিক গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) ল্যাবের জনক এবং জেনারেল ইলেকট্রিকের মতো একটি কর্পোরেট কিংবদন্তির স্রষ্টা। তার জীবন আমাদের শেখায় যে সাফল্য মানে শুধু নতুন কিছু তৈরি করা নয়, বরং সেই নতুনকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার পথ তৈরি করা। তার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার আজও আমাদের প্রযুক্তি, শিল্প এবং দৈনন্দিন জীবনকে প্রতিনিয়ত আলোকিত করে চলেছে।

টমাস আলভা এডিসনের কোন আবিষ্কারটি আপনার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়? কমেন্টে আমাদের জানান।

Leave a Comment

সম্পর্কিত পোস্টসমূহ

আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

Scroll to Top