জন ডি. রকফেলার: ইতিহাসের সেরা উদ্যোক্তা ও দানবীরের গল্প

জন ডি. রকফেলার: ইতিহাসের সেরা উদ্যোক্তা ও দানবীরের গল্প

Table of Contents

জন ডি. রকফেলার: ইতিহাসের সেরা উদ্যোক্তা ও দানবীরের গল্প

(ভূমিকা – Introduction)

এমন একজন ব্যক্তির কথা কল্পনা করুন, যার ব্যক্তিগত সম্পদ আজকের বাজারমূল্যে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলারের সমান—আধুনিক বিশ্বের টেক জায়ান্ট বিল গেটস, জেফ বেজোস এবং Elon মাস্কের সম্মিলিত সম্পদের চেয়েও যা বেশি। তিনি কেবল ইতিহাসের খাতায় আমেরিকার প্রথম বিলিয়নেয়ার হিসেবে নাম লেখাননি, বরং তাঁর কর্ম ও দর্শনের মাধ্যমে আধুনিক কর্পোরেট জগৎ এবং বিশ্বব্যাপী জনহিতকর কাজের ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন। তাঁর নাম জন ডেভিসন রকফেলার—এক নাম, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে কঠোর পরিশ্রম, অবিশ্বাস্য দূরদৃষ্টি, বিতর্কিত ব্যবসায়িক কৌশল এবং পরিশেষে এক অভাবনীয় রূপান্তরের গল্প।

রকফেলার ছিলেন একজন রহস্যময় ব্যক্তিত্ব। একদিকে তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠুর প্রতিযোগী, যিনি নিজের সাম্রাজ্য—স্ট্যান্ডার্ড অয়েল (Standard Oil)—গড়ে তোলার জন্য কোনো বাধাই মানতেন না। প্রতিযোগীদের বাজার থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া এবং একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি করার জন্য তিনি এমন সব কৌশল অবলম্বন করেছিলেন, যা আজও ব্যবসায়িক নীতিবিদ্যার আলোচনায় ঝড় তোলে। গণমাধ্যম তাকে “ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি” হিসেবেও আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠেই রয়েছে এক অন্য রকফেলার—একজন ধার্মিক, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ পরোপকারী ব্যক্তিত্ব। জীবনের শেষ ভাগে এসে তিনি তাঁর অর্জিত বিপুল সম্পদ এমনভাবে মানবকল্যাণে বিলিয়ে দিয়েছেন, যা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান, শিক্ষা এবং গবেষণার গতিপথই বদলে দিয়েছে।

এই পোস্টে আমরা জন ডি. রকফেলারের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় উন্মোচন করব। আমরা দেখব কীভাবে এক সাধারণ পরিবারের ছেলে নিজের মেধা, পরিশ্রম আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হলেন। আমরা তাঁর বিতর্কিত ব্যবসায়িক কৌশলগুলো বিশ্লেষণ করব এবং বোঝার চেষ্টা করব কেন তিনি একই সাথে শ্রদ্ধেয় এবং নিন্দিত ছিলেন। পরিশেষে, আমরা তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়—এক মহান দানবীর হিসেবে তাঁর রূপান্তর—এবং আজকের বিশ্বের ওপর তাঁর রেখে যাওয়া দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব। চলুন, শুরু করা যাক ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী এই কিংবদন্তির জীবনযাত্রা।

প্রারম্ভিক জীবন ও প্রথম পদক্ষেপ: এক ভবিষ্যৎ টাইকুনের জন্ম

যে কোনো বিশাল বটবৃক্ষের শুরুটা হয় একটি ক্ষুদ্র বীজ থেকে। জন ডি. রকফেলারের আকাশচুম্বী সাফল্যের পেছনেও ছিল তাঁর শৈশব এবং কৈশোরের বিশেষ এক ভিত্তি, যা তাঁর ভবিষ্যৎ চরিত্র ও কর্মপন্থার রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছিল। তাঁর বেড়ে ওঠার গল্পটা ছিল শৃঙ্খলা, চাতুর্য এবং কঠোর বাস্তবতার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ।

শৈশব ও পরিবারের প্রভাব: শৃঙ্খলা এবং কৌশলের প্রথম পাঠ

১৮৩৯ সালের ৮ই জুলাই নিউইয়র্কের রিচফোর্ডে এক সাধারণ পরিবারে জন ডি. রকফেলারের জন্ম। তাঁর চরিত্র গঠনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিলেন তাঁর মা, এলিজা ডেভিসন এবং বাবা, উইলিয়াম “বিগ বিল” রকফেলার—দুজন ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষ।

তাঁর মা ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ ব্যাপটিস্ট খ্রিস্টান। তিনি সন্তানদের কঠোর শৃঙ্খলা, মিতব্যয়িতা এবং ঈশ্বরের প্রতি অনুগত থেকে বড় করেছেন। মায়ের কাছ থেকেই রকফেলার পেয়েছিলেন তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র: “Work and save” (কাজ করো এবং সঞ্চয় করো)। এলিজা প্রায়ই বলতেন, “Willful waste makes woeful want” অর্থাৎ, “ইচ্ছাকৃত অপচয় ভয়ংকর অভাব ডেকে আনে।” এই শিক্ষা রকফেলার তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রতিটি পয়সার হিসাব রাখতেন এবং অপ্রয়োজনীয় খরচ এড়িয়ে চলতেন।

অন্যদিকে, তাঁর বাবা উইলিয়াম রকফেলার ছিলেন একজন ভ্রমণকারী বিক্রেতা এবং নিজেকে “বোটানিক ফিজিশিয়ান” হিসেবে পরিচয় দিলেও, আদতে তিনি ছিলেন একজন চতুর ব্যবসায়ী, এমনকি কেউ কেউ তাকে প্রতারকও বলত। “বিগ বিল” প্রায়ই পরিবার থেকে দূরে থাকতেন, কিন্তু যখনই ফিরতেন, তিনি তাঁর সন্তানদের জাগতিক ও ব্যবসায়িক চাতুর্যের পাঠ দিতেন। তিনি প্রায়ই তাঁর ছেলেদের সঙ্গে লেনদেনের সময় তাদের ঠকাতেন, আর এর কারণ হিসেবে বলতেন, “I cheat my boys every chance I get. I want to make ’em sharp.” (আমি সুযোগ পেলেই আমার ছেলেদের ঠকাই, কারণ আমি ওদেরকে চতুর বানাতে চাই)। বাবার এই অদ্ভুত শিক্ষাই হয়তো রকফেলারকে শিখিয়েছিল যে ব্যবসায়িক জগতে টিকে থাকতে হলে শুধু সৎ থাকলেই চলে না, চতুর এবং কৌশলীও হতে হয়।

এই দ্বৈত প্রভাবেই রকফেলারের চরিত্র গড়ে উঠেছিল। মায়ের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন সততা ও শৃঙ্খলা, আর বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন ঝুঁকি নেওয়ার সাহস ও ব্যবসায়িক দূরদৃষ্টি।

প্রথম চাকরি এবং ব্যবসার জগতে প্রবেশ

মাত্র ১৬ বছর বয়সে রকফেলার আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ করে চাকরির খোঁজে নামেন। তিন মাস ধরে ক্লিভল্যান্ডের প্রতিটি বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করার পর অবশেষে ১৮৫৫ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর তিনি ‘হিউইট অ্যান্ড টাটল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে সহকারী হিসাবরক্ষকের চাকরি পান। দিনটি তাঁর কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তিনি সারাজীবন এই দিনটিকে “চাকরি দিবস” বা “Job Day” হিসেবে নিজের জন্মদিনের চেয়েও বড় করে উদযাপন করতেন।

এই চাকরিতে তিনি তাঁর অসামান্য নিষ্ঠা এবং গাণিতিক দক্ষতার পরিচয় দেন। প্রতিটি হিসাব তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেলাতেন এবং ব্যবসার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো খুব দ্রুত আয়ত্ত করতে শুরু করেন। এখানেই তিনি মূলধন, পরিবহন খরচ এবং লাভের হিসাবের মতো জটিল বিষয়গুলোর বাস্তব জ্ঞান অর্জন করেন। চার বছরের কঠোর পরিশ্রমে তিনি প্রায় দুই হাজার ডলার সঞ্চয় করেন।

১৮৫৯ সালে, নিজের জমানো টাকা এবং বাবার কাছ থেকে ১০% সুদে ধার করা এক হাজার ডলার নিয়ে তিনি তাঁর সহকর্মী মরিস বি. ক্লার্কের সাথে ‘ক্লার্ক অ্যান্ড রকফেলার’ নামে একটি কৃষিপণ্য কেনাবেচার কমিশন ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম বছরেই তাঁদের লাভ হয় ৪,৪০০ ডলার। এই সাফল্য তাঁর আত্মবিশ্বাসকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় এবং তিনি বুঝতে পারেন যে অন্যের জন্য কাজ করার চেয়ে নিজের ব্যবসা গড়ার মধ্যেই তাঁর ভবিষ্যৎ নিহিত রয়েছে।

এক সাম্রাজ্যের উত্থান: স্ট্যান্ডার্ড অয়েল (Standard Oil)

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকা জুড়ে এক নতুন তরল সোনা আবিষ্কারের উন্মাদনা—পেট্রোলিয়াম। পেনসিলভেনিয়ার মাটিতে তেলের সন্ধান পাওয়ার পর হাজার হাজার মানুষ ভাগ্য ফেরানোর আশায় সেখানে ছুটে যায়। সবাই যখন তেল উত্তোলনের দিকে ছুটছিল, তখন তরুণ ব্যবসায়ী জন ডি. রকফেলার এই বিশৃঙ্খল শিল্পের মধ্যে এক বিশাল সুযোগ দেখতে পান। তিনি বুঝেছিলেন, তেল উত্তোলনের চেয়েও বেশি লাভজনক এবং স্থিতিশীল ব্যবসা হলো তেল পরিশোধন করা।

তেলের ব্যবসায় প্রবেশ: কেন এবং কীভাবে?

তৎকালীন সময়ে তেল ব্যবহার করা হতো মূলত কেরোসিন তৈরির জন্য, যা ছিল বাতি জ্বালানোর প্রধান জ্বালানি। রকফেলার দেখলেন, তেলের খনি হয়তো একদিন ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু যতক্ষণ এটি থাকবে, ততক্ষণ পরিশোধনের চাহিদা থাকবেই। তিনি তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার ক্লার্ক এবং রসায়নবিদ স্যামুয়েল অ্যান্ড্রুসের সাথে মিলে ১৮৬৩ সালে ক্লিভল্যান্ডে তাঁদের প্রথম তেল শোধনাগার স্থাপন করেন। অ্যান্ড্রুসের প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং রকফেলারের ব্যবসায়িক বুদ্ধি একসাথে হয়ে এক শক্তিশালী জুটি তৈরি করে।

রকফেলার শুরু থেকেই একটি বিষয়ে ছিলেন আপোসহীন—দক্ষতা (Efficiency)। তিনি কারখানার প্রতিটি প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত এবং সাশ্রয়ী করার জন্য 끊াে গবেষণা চালাতেন। যেখানে অন্য শোধনাগারগুলো অশোধিত তেলের ৬০% কেরোসিন হিসেবে পেত এবং বাকিটা বর্জ্য হিসেবে ফেলে দিত, সেখানে রকফেলার বর্জ্য থেকেও গ্যাসোলিন, প্যারাফিন ওয়াক্স এবং অন্যান্য উপজাত তৈরি করে সেগুলোও বিক্রি করতেন। এমনকি তিনি কারখানার জন্য নিজেদের ব্যারেল নিজেরাই তৈরি করতেন, যার ফলে খরচ প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে।

স্ট্যান্ডার্ড অয়েল প্রতিষ্ঠা এবং আগ্রাসী সম্প্রসারণ নীতি

১৮৭০ সালে জন ডি. রকফেলার, তাঁর ভাই উইলিয়াম রকফেলার এবং আরও কয়েকজন অংশীদার মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অফ ওহাইও’। নামটিই ছিল তাঁদের ব্যবসায়িক দর্শনের প্রতীক—তাঁরা তেলের একটি ‘স্ট্যান্ডার্ড’ বা মান নির্ধারণ করতে চেয়েছিলেন, যার ওপর গ্রাহকরা নির্ভর করতে পারে।

প্রতিষ্ঠার পরেই রকফেলার এক আগ্রাসী সম্প্রসারণ নীতি গ্রহণ করেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল পুরো তেল শিল্পকে একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসা। এর জন্য তিনি যে কৌশলটি ব্যবহার করেন, তা ছিল একইসাথে যুগান্তকারী এবং বিতর্কিত। তিনি তৎকালীন আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী শিল্প—রেলপথ কোম্পানিগুলোর—সাথে গোপন চুক্তি করেন। যেহেতু স্ট্যান্ডার্ড অয়েল বিপুল পরিমাণে তেল পরিবহন করত, তাই তিনি রেলপথগুলোকে একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ দিয়ে বিনিময়ে অবিশ্বাস্য ছাড় (Rebate) আদায় করেন। এই ছাড় এতটাই বেশি ছিল যে, তাঁর প্রতিযোগীদের পক্ষে স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের দামে তেল বিক্রি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের কৌশল: হরিজন্টাল ও ভার্টিকাল ইন্টিগ্রেশন

রকফেলারের সাম্রাজ্য বিস্তারের মূল ভিত্তি ছিল দুটি ব্যবসায়িক কৌশল:

  • হরিজন্টাল ইন্টিগ্রেশন (Horizontal Integration): এই কৌশলের মাধ্যমে রকফেলার তেল পরিশোধন শিল্পের সমস্ত প্রতিযোগীকে একে একে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। ১৮৭২ সালে, যা ইতিহাসে “ক্লিভল্যান্ড ম্যাসাকার” (Cleveland Massacre) নামে পরিচিত, তিনি মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে ক্লিভল্যান্ডের ২৬টি প্রতিযোগী শোধনাগারের মধ্যে ২২টিই কিনে নেন। তাঁর পদ্ধতি ছিল সহজ—তিনি প্রতিযোগীদের কাছে গিয়ে তাঁর সাশ্রয়ী উৎপাদন ও পরিবহন ব্যবস্থার হিসাব দেখাতেন এবং বলতেন, হয় তাঁরা স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের কাছে তাঁদের ব্যবসা বিক্রি করে দিক, অথবা প্রতিযোগিতায় হেরে দেউলিয়া হয়ে যাক। অনেকেই তাঁর প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হয়। মাত্র এক দশকের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল আমেরিকার ৯০ শতাংশেরও বেশি তেল পরিশোধন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে।
  • ভার্টিকাল ইন্টিগ্রেশন (Vertical Integration): পরিশোধন শিল্পে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর রকফেলার শিল্পের অন্যান্য দিকেও মনোযোগ দেন। তিনি তেলের পাইপলাইন, ট্যাঙ্কার গাড়ি, গুদাম এবং বিপণন নেটওয়ার্কও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এর ফলে, অশোধিত তেল উত্তোলন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত পণ্য গ্রাহকের বাতিতে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এই অভূতপূর্ব নিয়ন্ত্রণের ফলেই স্ট্যান্ডার্ড অয়েল হয়ে ওঠে আমেরিকার প্রথম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী একচেটিয়া কর্পোরেশন বা ট্রাস্ট।

সমালোচনা ও বিতর্ক: একজন নিষ্ঠুর ব্যবসায়ী?

স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের আকাশচুম্বী সাফল্য রকফেলারকে বিপুল সম্পদ এবং ক্ষমতা এনে দিলেও, তা বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। তাঁর ব্যবসায়িক কৌশলগুলো এতটাই নির্মম ছিল যে, সাধারণ মানুষ, গণমাধ্যম এবং সরকার—সবাই তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। তিনি ‘ক্যাপ্টেন অফ ইন্ডাস্ট্রি’ নাকি ‘রবার ব্যারন’ (দস্যু সর্দার)—এই বিতর্ক আজও অমীমাংসিত।

ব্যবসায়িক নীতির কঠোর সমালোচনা

রকফেলারের সাফল্যের পেছনে ছিল এক নির্মম বাস্তবতা: প্রতিযোগিতাকে তিনি সহ্য করতেন না। তাঁর লক্ষ্য ছিল সম্পূর্ণ আধিপত্য। এর জন্য তিনি এমন সব পন্থা অবলম্বন করেন যা নৈতিকতার মানদণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। গোপন চুক্তি, প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি, এবং প্রয়োজনে লোকসানে পণ্য বিক্রি করে প্রতিযোগীদের দেউলিয়া করে দেওয়া—এগুলো ছিল তাঁর সাধারণ কৌশল।

বিখ্যাত অনুসন্ধানী সাংবাদিক আইডা টারবেল (Ida Tarbell) তাঁর “The History of the Standard Oil Company” বইটিতে রকফেলারের অনৈতিক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের মুখোশ উন্মোচন করেন। টারবেলের বাবাও একজন তেল ব্যবসায়ী ছিলেন, যিনি রকফেলারের কারণে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন। তাঁর লেখনী আমেরিকার সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে এবং রকফেলার দ্রুতই কর্পোরেট লোভের প্রতীকে পরিণত হন। কার্টুনিস্টরা তাঁকে অক্টোপাসের মতো চিত্রিত করতেন, যার করাল থাবা দেশের অর্থনীতিকে গ্রাস করছে।

অ্যান্টি-ট্রাস্ট আইন এবং স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের পতন

জনগণের ক্রমবর্ধমান চাপ এবং ছোট ব্যবসায়ীদের সুরক্ষার তাগিদে মার্কিন সরকার একচেটিয়া ব্যবসার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। ১৮৯০ সালে ‘শারম্যান অ্যান্টি-ট্রাস্ট অ্যাক্ট’ (Sherman Antitrust Act) প্রণীত হয়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল মুক্ত বাজার নিশ্চিত করা এবং একচেটিয়া আধিপত্যকে ভেঙে দেওয়া।

এই আইনের আওতায় স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আইনি লড়াই শুরু হয়। অবশেষে ১৯১১ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে ঘোষণা করে যে, স্ট্যান্ডার্ড অয়েল একটি অবৈধ মনোপলি এবং এটি মুক্ত বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করছে। আদালত স্ট্যান্ডার্ড অয়েলকে ৩৪টি ভিন্ন কোম্পানিতে বিভক্ত করার নির্দেশ দেয়। বাহ্যিকভাবে এটি রকফেলারের সাম্রাজ্যের পতন মনে হলেও, বাস্তবে ঘটেছিল উল্টো। বিভক্ত হওয়া কোম্পানিগুলোর (যেমন Exxon, Mobil, Chevron) শেয়ারের মালিকানা রকফেলারের কাছেই ছিল এবং এই কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত বাজারমূল্য আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে যায়। ফলে, স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের পতন রকফেলারকে ইতিহাসের প্রথম বিলিয়নেয়ারে পরিণত করে।

দ্বিতীয় অধ্যায়: বিশ্বের অন্যতম সেরা দানবীর

ব্যবসা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেওয়ার পর জন ডি. রকফেলার তাঁর জীবনের শেষ ৪০ বছর উৎসর্গ করেন মানবকল্যাণে। যে ব্যক্তি একদিন সম্পদ অর্জনের জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন, তিনিই আবার সেই সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে হয়ে ওঠেন আধুনিক যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ পরোপকারী। তাঁর দানের পরিমাণ এবং দর্শন—দুটিই ছিল যুগান্তকারী।

দানের পেছনের দর্শন: বৈজ্ঞানিক জনহিতৈষণা (Scientific Philanthropy)

রকফেলার শুধু টাকা দান করেই দায়িত্ব শেষ করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন “বৈজ্ঞানিক জনহিতৈষণা” বা Scientific Philanthropy-তে। এর মূল কথা হলো, সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করে এমনভাবে বিনিয়োগ করা, যাতে সেই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়। তিনি দাতব্যকে একটি ব্যবসার মতোই দেখতেন, যেখানে প্রতিটি ডলারের সর্বোচ্চ উপযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। এই কাজে তাঁকে সহায়তা করার জন্য তিনি ফ্রেডরিক টেলর গেটসের মতো বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেন, যারা গবেষণা করে খুঁজে বের করতেন কোথায় এবং কীভাবে বিনিয়োগ করলে সমাজের সবচেয়ে বেশি উপকার হবে।

রকফেলার ফাউন্ডেশন এবং তার বৈশ্বিক প্রভাব

১৯১৩ সালে রকফেলার তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ জনহিতকর প্রতিষ্ঠান—রকফেলার ফাউন্ডেশন—প্রতিষ্ঠা করেন। এর লক্ষ্য ছিল “বিশ্বজুড়ে মানবজাতির কল্যাণ সাধন করা।” এই ফাউন্ডেশন বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক বিপ্লব নিয়ে আসে। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে পঙ্গু করে দেওয়া হুকওয়ার্ম রোগ নির্মূলের জন্য ফাউন্ডেশন ব্যাপক প্রচারণা চালায়। একইভাবে, পীতজ্বর (Yellow Fever) এবং ম্যালেরিয়ার মতো রোগের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে গবেষণা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তাদের অর্থায়নেই পীতজ্বরের টিকা আবিষ্কৃত হয়, যা কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে।

শিক্ষা ও গবেষণায় অবদান

রকফেলার গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষার মাধ্যমেই একটি জাতির উন্নতি সম্ভব। তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় (University of Chicago) প্রতিষ্ঠায় প্রায় ৮০ মিলিয়ন ডলার (আজকের হিসাবে কয়েক বিলিয়ন) দান করেন, যা একটি ছোট ব্যাপটিস্ট কলেজ থেকে বিশ্বের অন্যতম সেরা গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এছাড়াও, তিনি নিউইয়র্কে রকফেলার ইনস্টিটিউট ফর মেডিকেল রিসার্চ (যা এখন রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি হয়ে ওঠে জৈবচিকিৎসা গবেষণার এক পীঠস্থান এবং এখান থেকে বহু বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন।

রকফেলারের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার (Legacy)

৯৭ বছর বয়সে মৃত্যুর সময় জন ডি. রকফেলার এমন এক উত্তরাধিকার রেখে যান যা আজও বিশ্বকে প্রভাবিত করছে। তাঁর জীবন ও কর্ম আধুনিক পুঁজিবাদ, কর্পোরেট জগৎ এবং জনহিতকর কাজের ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।

আধুনিক কর্পোরেশনের জনক

রকফেলারকে প্রায়শই আধুনিক কর্পোরেশনের জনক বলা হয়। তিনি বিশৃঙ্খল তেল শিল্পকে একটি সুসংগঠিত কাঠামোতে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর তৈরি করা ‘ট্রাস্ট’ বা একীভূত কর্পোরেট কাঠামো, দক্ষতা এবং ব্যয় সংকোচনের ওপর তাঁর অবিশ্বাস্য মনোযোগ, এবং হরিজন্টাল ও ভার্টিকাল ইন্টিগ্রেশনের কৌশল—এই সবই পরবর্তী প্রজন্মের কর্পোরেশনগুলোর জন্য ব্লুপ্রিন্ট হয়ে ওঠে। ভালো বা মন্দ, তাঁর দেখানো পথেই আজকের বহুজাতিক সংস্থাগুলো পরিচালিত হয়।

বিতর্কিত বনাম দূরদর্শী: একটি দ্বৈত মূল্যায়ন

তাহলে জন ডি. রকফেলার কে ছিলেন? একজন নির্দয়, লোভী ব্যবসায়ী, যিনি প্রতিযোগীদের ধ্বংস করে নিজের সাম্রাজ্য গড়েছিলেন? নাকি একজন দূরদর্শী স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি একটি অস্থিতিশীল শিল্পকে স্থিতিশীল করে সাধারণ মানুষের জন্য পণ্যের দাম কমিয়ে এনেছিলেন? সত্যিটা হলো, তিনি দুটোই ছিলেন। তাঁর চরিত্রটি ছিল আমেরিকান পুঁজিবাদের মতোই জটিল—একদিকে সীমাহীন সুযোগ এবং উদ্ভাবন, অন্যদিকে নির্দয় প্রতিযোগিতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার। তাঁর দ্বৈত সত্তাই তাঁকে ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় এবং জটিল চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আজকের বিশ্বে রকফেলারের প্রভাব

রকফেলারের প্রভাব আজও আমাদের চারপাশে বিদ্যমান। স্ট্যান্ডার্ড অয়েল ভেঙে যে কোম্পানিগুলো তৈরি হয়েছিল, যেমন ExxonMobil এবং Chevron, সেগুলো আজও বিশ্বের সবচেয়ে বড় জ্বালানি সংস্থা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রকফেলার ফাউন্ডেশন এবং রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয় আজও বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান এবং শিক্ষার উন্নয়নে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে। তাঁর দেখানো পথেই পরবর্তীতে বিল গেটস এবং ওয়ারেন বাফেটের মতো বিলিয়নেয়াররা জনহিতকর কাজে এগিয়ে এসেছেন।

উপসংহার

জন ডেভিসন রকফেলারের জীবন এক মহাকাব্যের মতো, যেখানে উত্থান, পতন, বিতর্ক এবং রূপান্তরের প্রতিটি অধ্যায়ই নাটকীয়তায় পূর্ণ। এক সাধারণ হিসাবরক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এবং ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া, এবং অবশেষে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ দানবীরে রূপান্তরিত হওয়া—তাঁর যাত্রা এক কথায় অবিশ্বাস্য।

তাঁর ব্যবসায়িক নীতি হয়তো কঠোর এবং নির্মম ছিল, কিন্তু দক্ষতা, শৃঙ্খলা এবং দূরদৃষ্টির যে মান তিনি স্থাপন করেছিলেন, তা আজও ব্যবসায়িক জগতে প্রাসঙ্গিক। তবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হয়তো তাঁর দ্বিতীয় অধ্যায়ে নিহিত। তিনি দেখিয়েছেন যে অর্জিত সম্পদ কেবল নিজের ভোগের জন্য নয়, বরং তা মানবজাতির কল্যাণে ব্যয় করার মধ্যেই এর সার্থকতা। রকফেলারের বিতর্কিত অতীত হয়তো মুছে যাবে না, কিন্তু মানবকল্যাণে তাঁর অসামান্য অবদান তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রাখবে। তিনি শিখিয়েছেন যে, চূড়ান্ত বিচারে একজন মানুষের পরিচয় তার অর্জিত সম্পদে নয়, বরং সে তা দিয়ে সমাজের জন্য কী রেখে গেল তার ওপর নির্ভর করে।

জন ডি. রকফেলারের জীবন থেকে আপনার সবচেয়ে বড় শিক্ষা কী? কমেন্টে আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।

Leave a Comment

সম্পর্কিত পোস্টসমূহ

আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

Scroll to Top