অ্যান্ড্রু কার্নেগি/ Andrew Carnegie এক দরিদ্র ছেলের বিশ্বসেরা ধনী হওয়ার গল্প
ভূমিকা (Introduction)
ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু মানুষ আছেন, যাদের জীবন যেন এক মহাকাব্য। অ্যান্ড্রু কার্নেগি তেমনই এক নাম। কল্পনা করুন, স্কটল্যান্ডের এক হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া একটি ছেলে, যার শৈশব কেটেছে অনাহারে-অর্ধাহারে, সে কি না একদিন হয়ে উঠলো আমেরিকার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এবং ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ দানবীর! এটি কোনো রূপকথার গল্প নয়, এটি অ্যান্ড্রু কার্নেগির বাস্তব জীবনকাহিনী। তিনি শুধু আমেরিকার ইস্পাত শিল্পকেই (steel industry) এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করেননি, বরং সম্পদ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে এমন এক দর্শন তৈরি করেছিলেন, যা আজও বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের জন্য অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে আছে।
এই ব্লগ পোস্টে আমরা ডুব দেব অ্যান্ড্রু কার্নেগির জীবনের গভীরে। আমরা দেখব কীভাবে সামান্য একজন ববিন বয় থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক ইস্পাত-সম্রাট। আমরা তার যুগান্তকারী ব্যবসায়িক কৌশল, তার জীবনের বিতর্কিত অধ্যায় এবং তার বিখ্যাত দর্শন “The Gospel of Wealth” নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। তার জীবন শুধু একজন ব্যক্তির সাফল্যের গল্প নয়, এটি আমেরিকান স্বপ্নের এক মূর্ত প্রতীক। চলুন, এই কিংবদন্তির জীবন থেকে জেনে নেওয়া যাক ব্যবসা, সম্পদ এবং মানবকল্যাণ সম্পর্কে তার অমূল্য শিক্ষাগুলো।
শৈশব ও আমেরিকায় আগমন: এক নতুন সূচনার গল্প
প্রত্যেক মহীরুহের শুরুটা হয় একটি ছোট বীজ থেকে। অ্যান্ড্রু কার্নেগির জীবনের মহীরুহের বীজ রোপিত হয়েছিল স্কটল্যান্ডের চরম দারিদ্রে, আর তার অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল আমেরিকার অফুরন্ত সম্ভাবনার মাটিতে। তার শৈশব ছিল কঠোর পরিশ্রম আর টিকে থাকার এক নিরন্তর লড়াইয়ের গল্প।
স্কটল্যান্ডের ডুনফার্মলাইনে জন্ম ও দারিদ্র্য
১৮৩৫ সালের ২৫শে নভেম্বর, স্কটল্যান্ডের ডুনফার্মলাইন শহরের এক ছোট তাঁতির ঘরে জন্ম হয় অ্যান্ড্রু কার্নেগির। তার বাবা উইলিয়াম কার্নেগি ছিলেন একজন সম্মানিত তাঁতশিল্পী, কিন্তু সময়টা ছিল শিল্প বিপ্লবের। বাষ্পীয় তাঁতযন্ত্রের আগমনে হাতে বোনা কাপড়ের কদর কমে যাচ্ছিল দ্রুত। উইলিয়ামের মতো হাজারো তাঁতি তাদের পূর্বপুরুষের পেশা হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ছিলেন। কার্নেগির পরিবারে নেমে আসে চরম আর্থিক সংকট। প্রায়ই তাদের দিন কাটতো সামান্য খাবার বা কখনও অভুক্ত অবস্থায়।
এই কঠিন সময়ে ছোট্ট অ্যান্ড্রুর জীবনে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলেছিলেন তার মা, মার্গারেট মরিসন কার্নেগি। তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক নারী। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, তার ছেলেরা এই দারিদ্র্যের চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসবে। মার্গারেট ঘরেই জুতো সেলাই করে এবং ছোট একটি মুদি দোকান চালিয়ে কোনোমতে সংসার চালাতেন। তার এই লড়াকু মনোভাব অ্যান্ড্রুর মনে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার বেশিদূর এগোয়নি, মাত্র এক বছর স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার শেখার আগ্রহ ছিল অদম্য। তার কাকা জর্জ লডার তাকে স্কটিশ বীরদের গল্প শোনাতেন, রবার্ট বার্নসের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন, যা তার মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং স্কটিশ ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব তৈরি করেছিল।
যখন স্কটল্যান্ডে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল, তখন মার্গারেট এক দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন। তারা তাদের সামান্য সহায়-সম্বল বিক্রি করে এবং ধার করে আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমাবেন, যেখানে তাদের কিছু আত্মীয়স্বজন আগে থেকেই বাস করত। ১৮৪৮ সালে, তেরো বছর বয়সী অ্যান্ড্রু তার পরিবারের সাথে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরু করেন।
আমেরিকায় নতুন জীবনের সংগ্রাম
সাত সপ্তাহের কষ্টকর সমুদ্রযাত্রা শেষে কার্নেগি পরিবার পেনসিলভানিয়ার অ্যালেগেনি শহরে পৌঁছায়। কিন্তু আমেরিকার জীবনও ফুলের বিছানা ছিল না। এখানেও তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল কঠোর বাস্তবতা। পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তেরো বছর বয়সী অ্যান্ড্রুকে কাজে নামতে হলো। তার প্রথম কাজ ছিল একটি কটন মিলে ‘ববিন বয়’ হিসেবে। তার কাজ ছিল মেশিনের সুতোর স্পুল বা ববিন পরিবর্তন করা। সপ্তাহে মাত্র ১.২০ ডলারের জন্য তাকে দিনে ১২ ঘণ্টা স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার আর কোলাহলপূর্ণ এক কারখানায় কাজ করতে হতো। শৈশবের সব স্বপ্ন আর খেলাধুলাকে বিসর্জন দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন পরিবারের অন্যতম উপার্জনকারী।
এই অমানবিক পরিশ্রম তাকে ক্লান্ত করত, কিন্তু দমাতে পারত না। কাজের পর রাতে তিনি একটি নৈশ বিদ্যালয়ে পড়তে যেতেন। কিছুদিন পর তিনি আরেকটি কারখানায় কাজ পান, যেখানে বয়লার এবং স্টিম ইঞ্জিন দেখাশোনা করতে হতো। কাজটি ছিল আরও বিপজ্জনক, কিন্তু বেতন সামান্য বেশি ছিল। তবে অ্যান্ড্রুর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় তার পরের কাজটি। তিনি পিটসবার্গের এক টেলিগ্রাফ অফিসে মেসেঞ্জার হিসেবে কাজ পান।
এই কাজটি তার জন্য এক নতুন পৃথিবীর দরজা খুলে দেয়। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে হেঁটে হেঁটে তাকে বার্তা পৌঁছে দিতে হতো। এর ফলে তিনি শহরের সব রাস্তাঘাট এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো চিনে ফেলেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তিনি টেলিগ্রাফের মোর্স কোড শুনে শুনেই মুখস্থ করে ফেলেন। যেখানে অন্য অপারেটররা বার্তা লিখে তারপর পাঠাতেন, সেখানে অ্যান্ড্রু সরাসরি শুনেই বার্তা টাইপ করতে পারতেন। তার এই অসাধারণ দক্ষতা অফিসের কর্মকর্তাদের নজরে আসে এবং দ্রুতই তাকে টেলিগ্রাফ অপারেটর হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এই কাজটিই ছিল তার ভবিষ্যৎ সাফল্যের প্রথম সোপান। টেলিগ্রাফ অফিসের মাধ্যমে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যের খবরাখবর পেতেন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে তার পরিচয় হতো এবং তিনি বুঝতে পারছিলেন যে যোগাযোগের নেটওয়ার্কই হলো আধুনিক ব্যবসার মূল ভিত্তি।
সাফল্যের পথে যাত্রা: বিনিয়োগ ও স্টিল সাম্রাজ্য
কৈশোরের সংগ্রাম অ্যান্ড্রু কার্নেগিকে জীবনের যে পাঠ শিখিয়েছিল, তা দিয়েই তিনি তার যৌবনে সাফল্যের এক বিশাল ইমারত গড়তে শুরু করেন। তার মেধা, পরিশ্রম করার ক্ষমতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অসাধারণ দক্ষতা তাকে সাধারণ চাকুরিজীবী থেকে এক বিনিয়োগকারী এবং অবশেষে আমেরিকার স্টিল-সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতিতে পরিণত করে।
পেনসিলভানিয়া রেলরোড কোম্পানিতে যোগদান
টেলিগ্রাফ অপারেটর হিসেবে কাজ করার সময়, কার্নেগির দক্ষতা পেনসিলভানিয়া রেলরোড কোম্পানির অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা টমাস এ. স্কটের চোখে পড়ে। স্কট তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং কর্মনিষ্ঠা দেখে মুগ্ধ হন এবং তাকে নিজের ব্যক্তিগত সহকারী ও টেলিগ্রাফার হিসেবে নিয়োগ দেন। এটি ছিল কার্নেগির জীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট। স্কটের অধীনে কাজ করতে গিয়ে তিনি শুধু রেল ব্যবসার খুঁটিনাটিই শেখেননি, বরং কর্পোরেট দুনিয়ার ব্যবস্থাপনা, অর্থায়ন এবং নেটওয়ার্কিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও রপ্ত করেন।
স্কট ছিলেন তার পরামর্শদাতা। একবার একটি ট্রেন দুর্ঘটনার কারণে লাইনে বিশাল জট তৈরি হয় এবং স্কট অফিসে ছিলেন না। তরুণ কার্নেগি সাহসের সাথে স্কটের নামে বার্তা পাঠিয়ে পুরো লাইন ক্লিয়ার করার ব্যবস্থা করেন। তার এই দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা স্কটকে আরও মুগ্ধ করে। ধীরে ধীরে কার্নেগি কোম্পানিতে নিজের জায়গা পাকা করে নেন এবং তার পদোন্নতি হতে থাকে। স্কটের পরামর্শেই তিনি তার জীবনের প্রথম বিনিয়োগটি করেন। স্কট তাকে অ্যাডামস এক্সপ্রেস কোম্পানির ১০টি শেয়ার কেনার জন্য ৫০০ ডলার ধার দেন। এই বিনিয়োগ থেকে যখন প্রথম ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ হিসেবে ১০ ডলারের একটি চেক তার হাতে আসে, তখন তিনি激动িত (ecstatic) হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন, শুধু চাকরির বেতন নয়, টাকা দিয়েও টাকা আয় করা সম্ভব। এই উপলব্ধি তার মধ্যে এক নতুন উদ্যম তৈরি করে।
বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি
রেল কোম্পানিতে চাকরির পাশাপাশি কার্নেগি তার সমস্ত সঞ্চয় বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। আমেরিকান গৃহযুদ্ধের (Civil War) সময় তিনি বুদ্ধিমত্তার সাথে সঠিক জায়গাগুলোতে বিনিয়োগ করেন। তিনি থিওডোর টাটল উডরাফের স্লিপিং কার কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, লম্বা যাত্রাপথে মানুষ আরামে ঘুমানোর জন্য অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে চাইবে। তার এই ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয় এবং এই বিনিয়োগ তাকে বিশাল মুনাফা এনে দেয়।
এরপর তিনি তার বন্ধুদের সাথে মিলে ‘কিস্টোন ব্রিজ কোম্পানি’ (Keystone Bridge Company) নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। সেই সময়ে বেশিরভাগ ব্রিজ তৈরি হতো কাঠ দিয়ে, যা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ এবং অস্থায়ী। কার্নেগি লোহার ব্রিজ তৈরির ব্যবসায় নামেন এবং রেল কোম্পানিগুলো দ্রুতই তাদের কাঠের ব্রিজের বদলে লোহার ব্রিজ ব্যবহার করতে শুরু করে। এই ব্যবসাও তাকে বিপুল অর্থ এনে দেয়। তিনি শুধু সুযোগ খুঁজতেন না, সুযোগ তৈরি করতেন। পেনসিলভানিয়ার তেল খনি থেকে শুরু করে লোহার কারখানা—যেখানেই তিনি সম্ভাবনা দেখতেন, সেখানেই বিনিয়োগ করতেন। ৩০ বছর বয়স হওয়ার আগেই তিনি একজন ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন এবং তার বার্ষিক আয় ৫০,০০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়, যা সেই সময়ের হিসাবে এক বিশাল অঙ্ক। কিন্তু কার্নেগির লক্ষ্য ছিল আরও বড়। তিনি শুধু বিনিয়োগকারী হয়ে থাকতে চাননি; তিনি চেয়েছিলেন নিজের একটি শিল্প সাম্রাজ্য গড়তে।
কার্নেগি স্টিল কোম্পানির প্রতিষ্ঠা: একটি বিপ্লব
১৮৭০-এর দশকের শুরুতে এক ইউরোপ ভ্রমণের সময় কার্নেগি ইংল্যান্ডে হেনরি বেসিমারের সাথে দেখা করেন এবং তার revolutionary ‘বেসিমার প্রক্রিয়া’ (Bessemer process) দেখেন। এই প্রক্রিয়ায় খুব অল্প সময়ে এবং কম খরচে বিপুল পরিমাণে তরল লোহা থেকে ইস্পাত বা স্টিল তৈরি করা যেত। কার্নেগি সঙ্গে সঙ্গে এর গুরুত্ব অনুধাবন করেন। তিনি বুঝতে পারেন, ভবিষ্যৎ হলো স্টিলের যুগ। রেললাইন, ব্রিজ, বড় বড় দালান—সবকিছুতেই কাঠের বদলে স্টিল ব্যবহার হবে।
আমেরিকায় ফিরে এসে তিনি তার সমস্ত বিনিয়োগ এক জায়গায় করে পিটসবার্গের কাছে তার প্রথম স্টিল কারখানা ‘এডগার থমসন স্টিল ওয়ার্কস’ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তিনি শুধু একটি কারখানা খুলেই থেমে থাকেননি। তিনি ব্যবসায় এমন এক মডেল প্রয়োগ করেন যা আগে কেউ ভাবেনি—এর নাম ‘উল্লম্ব একীকরণ’ (Vertical Integration)। এর অর্থ হলো, স্টিল তৈরির জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সবকিছু তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। তিনি লোহার খনি কিনে নেন, কয়লার খনি কিনে নেন, কাঁচামাল পরিবহনের জন্য জাহাজ এবং রেললাইনও কিনে নেন। এর ফলে কাঁচামাল কেনা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত পণ্য তৈরি এবং তা বাজারে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে খরচ কমে আসে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার উপর তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই কৌশলের ফলে কার্নেগি স্টিল কোম্পানি অবিশ্বাস্য কম দামে স্টিল উৎপাদন করতে সক্ষম হয়, যা তার প্রতিযোগীদের বাজার থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। তিনি ক্রমাগত কারখানার আধুনিকায়ন করতেন এবং উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতেন। তার মূলমন্ত্র ছিল—”Watch the costs and the profits will take care of themselves” (খরচের দিকে নজর রাখো, মুনাফা নিজের খেয়াল নিজেই রাখবে)। এই নীতির উপর ভর করে কার্নেগি স্টিল কোম্পানি খুব দ্রুত আমেরিকার বৃহত্তম এবং বিশ্বের অন্যতম লাভজনক কোম্পানিতে পরিণত হয়। অ্যান্ড্রু কার্নেগি হয়ে ওঠেন আমেরিকার无可争议 (undisputed) স্টিল-কিং।
“গসপেল অফ ওয়েলথ” এবং তার যুগান্তকারী দর্শন
অ্যান্ড্রু কার্নেগি শুধু একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন গভীর চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়, অর্থাৎ সম্পদ অর্জনের পরের পর্বটি ছিল আরও বেশি বিপ্লবী। এই পর্বে তিনি বিশ্বকে উপহার দেন তার বিখ্যাত দর্শন—”The Gospel of Wealth” বা “সম্পদের সুসমাচার”। এই দর্শন তাকে একজন সাধারণ ধনকুবের থেকে ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবপ্রেমীতে রূপান্তরিত করে।
সম্পদ সম্পর্কে কার্নেগির ধারণা
১৮৮৯ সালে কার্নেগি “North American Review” ম্যাগাজিনে একটি প্রবন্ধ লেখেন, যার শিরোনাম ছিল “Wealth”। এটিই পরে “The Gospel of Wealth” নামে পরিচিতি পায়। এই প্রবন্ধে তিনি সম্পদ এবং তার মালিকের দায়িত্ব সম্পর্কে কিছু যুগান্তকারী ধারণা তুলে ধরেন, যা তৎকালীন পুঁজিবাদী সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
তার দর্শনের মূল কথা ছিল: ১. সম্পদের দুটি অংশ: একজন ব্যক্তির জীবনে অর্জিত সম্পদ দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশটি হলো তার নিজের এবং পরিবারের ভরণপোষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ। দ্বিতীয় অংশটি হলো উদ্বৃত্ত সম্পদ, যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত। কার্নেগির মতে, এই উদ্বৃত্ত সম্পদ সমাজের আমানত এবং এর মালিক হলেন সেই সমাজের একজন ট্রাস্টি বা অছি। ২. উত্তরাধিকারের বিরোধিতা: তিনি বংশানুক্রমে বিপুল সম্পদ হস্তান্তরের তীব্র বিরোধী ছিলেন। তার মতে, সন্তানদের জন্য বিপুল সম্পদ রেখে যাওয়া তাদের জন্য আশীর্বাদের চেয়ে অভিশাপ বেশি। এটি তাদের অলস, অকর্মণ্য এবং সমাজের জন্য বোঝায় পরিণত করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রত্যেক প্রজন্মকে নিজের ভাগ্য নিজেকেই গড়তে হবে। ৩. জীবদ্দশায় দান: কার্নেগির সবচেয়ে বিপ্লবী ধারণাটি ছিল, ধনীদের উচিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা না করে তাদের জীবদ্দশাতেই সমাজের কল্যাণে নিজেদের উদ্বৃত্ত সম্পদ বিলিয়ে দেওয়া। তার সেই বিখ্যাত উক্তিটি এখানে প্রণিধানযোগ্য: “The man who dies thus rich dies disgraced” অর্থাৎ, “যে মানুষ ধনী হয়ে মারা যায়, সে অসম্মানিত হয়ে মারা যায়।”
এই দর্শন ছিল তৎকালীন সমাজের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত, যেখানে সম্পদ জমা করা এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়াই ছিল আভিজাত্যের প্রতীক।
দানের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি
কার্নেগি শুধু দান করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি ভেবেছিলেন কীভাবে দান করলে তা সমাজের সবচেয়ে বেশি উপকারে আসবে। তিনি খয়রাতি বা চ্যারিটিকে নিরুৎসাহিত করতেন। তার মতে, কোনো দরিদ্র ব্যক্তিকে সরাসরি অর্থ সাহায্য করা তাকে আরও পরনির্ভরশীল করে তোলে। তিনি একে বলতেন “অযোগ্য দয়া” (unworthy charity)।
এর পরিবর্তে তিনি এক “বৈজ্ঞানিক জনহিতৈষণা” (Scientific Philanthropy) নীতিতে বিশ্বাস করতেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল এমন সব প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, যা মানুষকে自立 (self-reliant) হতে এবং নিজেদের উন্নতি করার সুযোগ করে দেবে। তিনি সরাসরি মাছ না দিয়ে, মাছ ধরার কৌশল শিখিয়ে দেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। এই কারণেই তিনি তার অর্থ এমন সব খাতে বিনিয়োগ করেছেন যা দীর্ঘমেয়াদে সমাজের জ্ঞান, সংস্কৃতি এবং সম্ভাবনার ভিত্তি গড়ে তোলে। শিক্ষা, গ্রন্থাগার, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, শিল্পকলা এবং বিশ্বশান্তি ছিল তার দানের প্রধান ক্ষেত্র। তিনি চাইতেন, তার অর্থ যেন এমন এক সিঁড়ি তৈরি করে, যা ব্যবহার করে যে কোনো পরিশ্রমী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, ঠিক যেমনটি তিনি নিজে করেছিলেন।
ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ দানবীর: যে ঐতিহ্য আজও বেঁচে আছে
অ্যান্ড্রু কার্নেগি তার দর্শনকে শুধু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি তার জীবনের শেষ দুই দশক উৎসর্গ করেছিলেন অর্জিত প্রায় সমস্ত সম্পদ সমাজের কল্যাণে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য। তার দানের পরিমাণ এবং তার প্রভাব এতটাই বিশাল ছিল যে, তা তাকে “আধুনিক জনহিতৈষণার জনক” (Father of Modern Philanthropy) হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে। তার তৈরি করা প্রতিষ্ঠানগুলো আজও বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে চলেছে।
লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা: জ্ঞানের আলো ছড়ানো
কার্নেগির জনহিতৈষণার সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলো বিশ্বজুড়ে পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা। শৈশবে তিনি কর্নেল জেমস অ্যান্ডারসনের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে বিনামূল্যে বই পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই অভিজ্ঞতা তার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তিনি বুঝেছিলেন, জ্ঞানই হলো উন্নতির চাবিকাঠি। তাই তিনি চেয়েছিলেন, তার মতো যে কোনো সাধারণ মানুষ যেন বিনামূল্যে বই পড়ার সুযোগ পায়।
তিনি আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা এবং অন্যান্য দেশে মোট ২,৫০৯টি লাইব্রেরি নির্মাণে অর্থায়ন করেন। তবে তার লাইব্রেরি দানের একটি শর্ত ছিল। তিনি শুধু ভবন নির্মাণের টাকা দিতেন, কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনকে বই কেনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং কর্মীদের বেতন দেওয়ার জন্য তহবিল গঠন করতে হতো। এর মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত করতেন যে, স্থানীয় মানুষও এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানার অংশীদার হোক এবং এর প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ তৈরি হোক। এই লাইব্রেরিগুলোকে তিনি “জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়” (University of the People) বলে মনে করতেন, যা সবার জন্য উন্মুক্ত।
শিক্ষা ও গবেষণায় অবদান
কার্নেগি বিশ্বাস করতেন, একটি শিক্ষিত জাতিই দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাই তার দানের একটি বড় অংশ গিয়েছিল শিক্ষা ও গবেষণার প্রসারে। ১৯০০ সালে তিনি পিটসবার্গে “কার্নেগি টেকনিক্যাল স্কুল” প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজ বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় “কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটি” (Carnegie Mellon University) নামে পরিচিত।
তিনি বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্যও ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ১৯০২ সালে তিনি “কার্নেগি ইনস্টিটিউশন ফর সায়েন্স” প্রতিষ্ঠা করেন, যা জ্যোতির্বিদ্যা থেকে শুরু করে জীববিজ্ঞান পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুগান্তকারী গবেষণায় সহায়তা করেছে। এছাড়াও, তিনি আমেরিকার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের পর আর্থিক সুরক্ষার জন্য একটি পেনশন ফান্ড তৈরি করেন, যা আজ “TIAA-CREF” নামে পরিচিত এবং লক্ষ লক্ষ শিক্ষাবিদকে পরিষেবা দিয়ে চলেছে।
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা
জীবনের শেষ দিকে কার্নেগি বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি যুদ্ধকে মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় অভিশাপ বলে মনে করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশগুলোর মধ্যে বিবাদ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। এই লক্ষ্যে তিনি নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে আন্তর্জাতিক আদালত বা “পিস প্যালেস” (Peace Palace) নির্মাণের জন্য বিপুল অর্থ দান করেন।
১৯১০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস” (Carnegie Endowment for International Peace)। এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হলো দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং যুদ্ধ প্রতিরোধে কাজ করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হন, কারণ তার শান্তির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি আজও বিশ্বজুড়ে কূটনীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
সমালোচনা ও বিতর্ক: কিংবদন্তির আড়ালের বাস্তবতা
অ্যান্ড্রু কার্নেগিকে একদিকে যেমন একজন মহান দানবীর হিসেবে দেখা হয়, তেমনই তার জীবনের অন্য একটি দিক ছিল চরম বিতর্কিত। তার ইস্পাত সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল হাজারো শ্রমিকের কঠোর পরিশ্রম এবং ত্যাগের উপর। মুনাফা সর্বোচ্চ করার জন্য তিনি এমন সব নীতি গ্রহণ করেছিলেন, যা তাকে শ্রমিকদের চোখে একজন নির্দয় পুঁজিপতিতে পরিণত করে। তার কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতির আড়ালে লুকিয়ে আছে শোষণ এবং সহিংসতার কালো দাগ।
হোমস্টেড স্ট্রাইক (The Homestead Strike of 1892)
কার্নেগির জীবনের সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় হলো ১৮৯২ সালের হোমস্টেড স্ট্রাইক। পেনসিলভানিয়ার হোমস্টেডে অবস্থিত তার প্রধান স্টিল কারখানার শ্রমিকরা মজুরি কমানোর প্রতিবাদে এবং ইউনিয়ন গঠনের অধিকারের দাবিতে ধর্মঘট শুরু করে। সেই সময় কার্নেগি স্কটল্যান্ডে ছুটিতে ছিলেন এবং কারখানার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন তার কঠোর সহযোগী হেনরি ক্লে ফ্রিক।
ফ্রিক শ্রমিকদের দাবি মানতে অস্বীকার করেন এবং কারখানা থেকে ইউনিয়নের সব সদস্যকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ধর্মঘট ভাঙার জন্য কুখ্যাত পিংকারটন এজেন্সির ৩০০ জন সশস্ত্র প্রহরী ভাড়া করেন। যখন এই প্রহরীরা নদীপথে কারখানায় প্রবেশের চেষ্টা করে, তখন শ্রমিকদের সাথে তাদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। দিনব্যাপী এই লড়াইয়ে বেশ কয়েকজন শ্রমিক ও প্রহরী নিহত হয় এবং অনেকে আহত হয়। অবশেষে রাজ্যের গভর্নর ন্যাশনাল গার্ড পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। ধর্মঘট ব্যর্থ হয়, ইউনিয়ন ভেঙে দেওয়া হয় এবং শ্রমিকরা আগের চেয়েও কম মজুরিতে কাজে ফিরতে বাধ্য হয়।
যদিও কার্নেগি নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলেন না, কিন্তু তিনি ফ্রিকের নেওয়া পদক্ষেপগুলোকে সমর্থন করেছিলেন। এই ঘটনা তার “শ্রমিকদের বন্ধু” ভাবমূর্তিকে চূর্ণ করে দেয়। বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যম তাকে একজন ভণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করে, যিনি একদিকে লাইব্রেরি তৈরি করছেন, অন্যদিকে নিজের শ্রমিকদের রক্ত ঝরাচ্ছেন।
কর্মীদের প্রতি কঠোর মনোভাব
হোমস্টেড স্ট্রাইক কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। কার্নেগির কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের জীবন ছিল অত্যন্ত দুর্বিষহ। তাদের দিনে ১২ ঘণ্টা, সপ্তাহে ৭ দিন গলন্ত ধাতুর চুল্লির পাশে বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করতে হতো। প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটত, এবং তাতে বহু শ্রমিক মারা যেত বা পঙ্গু হয়ে যেত। এর বিনিময়ে তারা যে মজুরি পেত, তা ছিল অত্যন্ত সামান্য।
কার্নেগি উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য শ্রমিকদের মজুরি যতটা সম্ভব কম রাখতেন এবং ইউনিয়নের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইউনিয়নগুলো কারখানার উৎপাদনশীলতা নষ্ট করে। তার এই নির্দয় ব্যবসায়িক নীতি এবং তার জনহিতৈষণামূলক কাজের মধ্যে যে বিশাল বৈপরীত্য, তা তাকে ইতিহাসের এক জটিল ও বিতর্কিত চরিত্রে পরিণত করেছে। তিনি একদিকে মানবজাতির উন্নতির জন্য সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছেন, অন্যদিকে সেই সম্পদ আহরণের জন্য সাধারণ মানুষের উপর শোষণ চালিয়েছেন।
শেষ জীবন ও উত্তরাধিকার (Legacy)
জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে অ্যান্ড্রু কার্নেগি তার ব্যবসায়িক পরিচয় পুরোপুরি মুছে ফেলে একজন পূর্ণকালীন মানবপ্রেমী হয়ে ওঠেন। তিনি তার জীবনের প্রথম অর্ধেক কাটিয়েছিলেন সম্পদ উপার্জন করে, আর দ্বিতীয় অর্ধেক কাটিয়েছিলেন সেই সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে। তার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার শুধু তার তৈরি করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার দর্শন আজও মানবকল্যাণের এক শাশ্বত প্রেরণা হয়ে রয়েছে।
স্কটল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন এবং শেষ দিনগুলো
১৯০১ সালে, ৬৫ বছর বয়সে অ্যান্ড্রু কার্নেগি এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার বিশাল ইস্পাত সাম্রাজ্য, কার্নেগি স্টিল কোম্পানি, তৎকালীন সময়ের রেকর্ড ৪৮০ মিলিয়ন ডলারে (আজকের হিসাবে যা প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য) জে.পি. মর্গানের কাছে বিক্রি করে দেন। এই চুক্তি তাকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত করে। এরপর তিনি ব্যবসা থেকে পুরোপুরি অবসর নেন।
বিক্রির পর জে.পি. মর্গান তাকে বলেছিলেন, “মিস্টার কার্নেগি, আমি আপনাকে আমেরিকার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হওয়ায় অভিনন্দন জানাতে চাই।” কার্নেগি তার বাকি জীবন কাটানোর জন্য তার জন্মভূমি স্কটল্যান্ডে ফিরে যান এবং সেখানে স্কিম্বো ক্যাসেল (Skibo Castle) কিনে নেন। জীবনের শেষ ১৮ বছর তিনি এখানেই কাটান এবং তার একমাত্র কাজ ছিল তার বিপুল সম্পদ মানবকল্যাণে বিলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। ১৯১৯ সালে ৮৩ বছর বয়সে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি তার মোট সম্পদের প্রায় ৯০ শতাংশ, অর্থাৎ ৩৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি, দান করে গিয়েছিলেন।
আজকের বিশ্বে কার্নেগির প্রাসঙ্গিকতা
অ্যান্ড্রু কার্নেগির প্রভাব আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তার “The Gospel of Wealth” দর্শনটি একবিংশ শতাব্দীর ধনকুবেরদের জন্য এক নতুন পথের দিশা দেখিয়েছে। বিল গেটস এবং ওয়ারেন বাফেট দ্বারা অনুপ্রাণিত “The Giving Pledge” উদ্যোগটি কার্নেগির দর্শনেরই এক আধুনিক রূপ। এই উদ্যোগে বিশ্বের শত শত বিলিয়নেয়ার তাদের সম্পদের সিংহভাগ জনকল্যাণে দান করার প্রতিজ্ঞা করেছেন।
কার্নেগি প্রমাণ করে গেছেন যে, ব্যবসায়িক সাফল্য এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা একসাথে চলতে পারে। তার জীবন আমাদের দেখায় যে, একজন ব্যক্তির চূড়ান্ত পরিমাপ তার অর্জিত সম্পদের পরিমাণে নয়, বরং সেই সম্পদ তিনি কীভাবে মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করলেন, তার উপর নির্ভর করে। তার প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরি, বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা কেন্দ্রগুলো আজও জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
উপসংহার (Conclusion)
অ্যান্ড্রু কার্নেগির জীবন ছিল বৈপরীত্যে ভরা এক মহাকাব্য। তিনি একদিকে ছিলেন একজন নির্দয়, কঠোর পুঁজিপতি, যিনি মুনাফার জন্য শ্রমিকদের শোষণ করতে দ্বিধা করেননি। অন্যদিকে, তিনি ছিলেন একজন অবিশ্বাস্য দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং উদার দানবীর, যিনি বিশ্বাস করতেন যে তার অর্জিত সম্পদ সমাজেরই প্রাপ্য। তার গল্প আমাদের এই জটিল সত্যের মুখোমুখি করে যে, ইতিহাসে নায়কেরা সবসময় সাদাকালো হয় না; তাদের চরিত্রে ধূসর রঙের ছটাও থাকে।
তিনি আমাদের শিখিয়েছেন যে, সম্পদ অর্জন করা জীবনের একটি অংশ মাত্র, কিন্তু সেই সম্পদকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়, সেটাই একজন মানুষের প্রকৃত পরিচয় তৈরি করে। তার ইস্পাত সাম্রাজ্য আজ ইতিহাসের অংশ, কিন্তু তার তৈরি করা লাইব্রেরি, তার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার মানবকল্যাণের দর্শন আজও অমর। অ্যান্ড্রু কার্নেগির আসল উত্তরাধিকার তার স্টিল নয়, বরং তার সেই অমোঘ বার্তা: “যে মানুষ ধনী হয়ে মারা যায়, সে অসম্মানিত হয়ে মারা যায়।” তার জীবন আমাদের ভাবতে বাধ্য করে—আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী রেখে যেতে চাই? শুধুই সম্পদ, নাকি এমন কিছু যা তার চেয়েও অনেক বেশি মূল্যবান?
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ Section)
- প্রশ্ন ১: অ্যান্ড্রু কার্নেগি আজকের হিসাবে কতটা ধনী ছিলেন?
- উত্তর: আজকের হিসাবে তার সম্পদ প্রায় ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি হতো, যা তাকে ইতিহাসের অন্যতম ধনী ব্যক্তি করে তুলেছে।
- প্রশ্ন ২: “গসপেল অফ ওয়েলথ” এর মূল কথা কী?
- উত্তর: এর মূল কথা হলো, অর্জিত অতিরিক্ত সম্পদ মৃত্যুর আগে সমাজের কল্যাণে ব্যয় করা প্রত্যেক ধনী ব্যক্তির নৈতিক দায়িত্ব।
- প্রশ্ন ৩: অ্যান্ড্রু কার্নেগিকে কেন স্মরণ করা হয়?
- উত্তর: তাকে মূলত দুটি কারণে স্মরণ করা হয়: প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্টিল শিল্পকেปฏิวัติ (revolutionize) করার জন্য এবং দ্বিতীয়ত, তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ শিক্ষা ও জনকল্যাণে দান করার জন্য।
- প্রশ্ন ৪: হোমস্টেড স্ট্রাইক কী ছিল?
- উত্তর: এটি ছিল ১৮৯২ সালে কার্নেগির স্টিল কারখানার শ্রমিকদের দ্বারা সংঘটিত একটি ধর্মঘট, যা সহিংসতায় রূপ নিয়েছিল এবং কার্নেগির সুনামে একটি বড় দাগ ফেলেছিল।