অন্তর মিয়ার ছাগলের খামারঘুরে দাঁড়ানোর গল্প (The story of Antar Mia’s goat standing around the farm)
আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত হাজারো তরুণ স্বপ্ন দেখে। কেউ শহরে পাড়ি জমায়, কেউ বেছে নেয় কর্পোরেট জীবনের নিরাপত্তা। কিন্তু এমন কিছু মানুষ থাকে, যারা স্রোতের বিপরীতে হাঁটার সাহস দেখায়। তারা শেকড়কে ভুলে যায় না, বরং সেই শেকড়কেই শক্তিতে পরিণত করে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে। এই গল্পটি তাদেরই একজনের—বগুড়ার সোনাতলা গ্রামের এক সাধারণ ছেলে অন্তর মিয়ার।
এই গল্প শুধু একটি ছাগলের খামার তৈরির নয়; এই গল্প শূন্য থেকে শুরু করার, একবার হোঁচট খেয়ে আবার উঠে দাঁড়ানোর, আর নিজের সততা ও পরিশ্রম দিয়ে ভাগ্যকে জয় করার। চলুন, আমরা অন্তর মিয়ার সেই অসাধারণ পথচলার সঙ্গী হই।
শৈশব ও বেড়ে ওঠা (Childhood and upbringing)
বগুড়ার সোনাতলা গ্রামের মেঠো পথ আর ফসলের কড়া গন্ধ মেখেই বড় হয়েছে অন্তর মিয়া। তার শৈশবের স্মৃতির ক্যানভাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল ছবি ছিল তার বাবার—ঘামে ভেজা শরীর, কপালে চিন্তার গভীর ভাঁজ আর উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। সে খুব কাছ থেকে দেখেছে, কীভাবে তার বাবা দিনরাত এক করে কখনও আলুর খেতে, কখনও ধানের জমিতে পড়ে থাকতেন। কিন্তু বছরের শেষে হয় বাজারের নির্দয় দালালের কারসাজি, না হয় প্রকৃতির নির্মম পরিহাস—অসময়ের বৃষ্টি বা খরা—সবকিছু কেড়ে নিত। বাবার মুখে ফুটে ওঠা সেই অসহায়ত্বের ছায়াটা ছোট্ট অন্তরের বুকে ছুরির মতো গেঁথে গিয়েছিল।
সে বুঝতে পারত, শুধু গায়ের জোরে মাটির সাথে যুদ্ধ করে এই চক্র ভাঙা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন নতুন কোনো পথ, নতুন কোনো জ্ঞান, নতুন কোনো কৌশল। স্কুলের চার দেয়ালের ভেতর জীববিজ্ঞানের ক্লাসটা তাকে সবচেয়ে বেশি টানত। যখন শিক্ষক পশু-পাখির প্রজনন, উন্নত জাতের ফসল বা বৈজ্ঞানিক খামার ব্যবস্থাপনার কথা বলতেন, অন্তর যেন ঘোরের মধ্যে চলে যেত। সে তার গ্রামের ভবিষ্যৎ, তার বাবার হাসিমুখের ছবি দেখতে পেত। তার সমবয়সীরা যখন শহরে গিয়ে গার্মেন্টসে চাকরি করার রঙিন স্বপ্ন দেখত, অন্তর তখন ভাবত, কীভাবে এই উর্বর মাটিকে ব্যবহার করেই গ্রামের ভাগ্য ফেরানো যায়। তাই উচ্চমাধ্যমিকের পর কৃষিতে ডিপ্লোমা পড়ার সিদ্ধান্তটা ছিল সেই আকাশছোঁয়া স্বপ্নের দিকে তার প্রথম বাস্তব পদক্ষেপ।
ব্যবসার প্রেরণা পাওয়া (Getting business motivation)
ডিপ্লোমা শেষ করে একটি বীজ কোম্পানির মাঠকর্মী হিসেবে চাকরিটা ছিল অন্তরের জন্য এক বিশাল পাঠশালা। মাইলের পর মাইল মোটরসাইকেলে ছুটে সে ঘুরত এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে, কথা বলত শত শত কৃষকের সাথে। তাদের সাফল্য, তাদের ব্যর্থতা—সবকিছুই সে নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা করত।
এই ঘুরতে গিয়েই একদিন যশোরের এক আধুনিক ছাগলের খামারে তার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। সেটা ছিল প্রচলিত কোনো ছাগলের খোঁয়াড় নয়, রীতিমতো একটি গোছানো শিল্প। কাঠের উঁচু খুঁটির ওপর ঝকঝকে টিনের চালার নিচে শত শত উন্নত জাতের ছাগল—ব্ল্যাক বেঙ্গল, তোতাপুরী। কোনো ময়লা বা তীব্র দুর্গন্ধ নেই, বরং বাতাসে ভাসছে শুকনো খড়ের মিষ্টি গন্ধ। ছাগলগুলো খাচ্ছে পরিমিত ও পুষ্টিকর খাবার, আর খামারের মালিক ল্যাপটপে বসে প্রত্যেকটি ছাগলের স্বাস্থ্য, ওজন আর লাভের নিখুঁত হিসাব রাখছেন।
অন্তর বিস্ময়ের সাথে শুনল, সেই খামারি শুধু স্থানীয় বাজারেই আটকে নেই, ঢাকার বড় বড় সুপারশপের সাথেও তার মাংস সরবরাহের চুক্তি রয়েছে। তিনি बातों बातों में বললেন, “ভাই, খাঁটি জিনিস দিতে পারলে ক্রেতার অভাব হয় না। আমাদের ব্ল্যাক বেঙ্গলের চামড়ার চাহিদা তো বিদেশেও আছে, আর মাংসের বাজার তো সবসময়ই চাঙ্গা। ঠিকমতো علم খাটিয়ে করতে পারলে, এটাই সোনার হরিণ।”
সেই রাতে হোটেলে ফিরে অন্তরের আর ঘুম এলো না। তার চোখের সামনে বারবার ভাসছিল ওই ঝকঝকে খামার, ছাগলগুলোর সুস্থ-সবল চেহারা আর ল্যাপটপের স্ক্রিনে লাভের হিসাব। সে বুঝতে পারল, সে তার জীবনের পথ খুঁজে পেয়েছে। গতানুগতিক কৃষির বাইরে এটাই সেই নতুন জগৎ, যা শুধু তার নিজের নয়, সোনাতলার আরও অনেক তরুণের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। চাকরির নিশ্চয়তাকে পেছনে ফেলে সে গ্রামে ফিরে নিজের গল্প লেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল।
প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ (The primary challenges)
স্বপ্ন দেখা যত সহজ, তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া ততটাই কঠিন। গ্রামে ফিরে অন্তর যখন তার স্বপ্নের কথা বলল, প্রথম এবং সবচেয়ে কঠিন বাধাটা এলো নিজের ঘর থেকেই। তার বাবা, একজন পোড় খাওয়া কৃষক, যিনি সারাজীবন মাটির সাথে যুদ্ধ করে এসেছেন, ছেলের কথায় আঁতকে উঠলেন। “এত কষ্ট করে তোকে লেখাপড়া শেখালাম একটা ভালো চাকরির জন্য। আর তুই কি না সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ছাগল পালবি? শেষে কি আমার মতোই মাটির সাথেই যুদ্ধ করে মরবি?” বাবার গলায় রাগ ছিল না, ছিল গভীর ভয় আর হতাশা।
এরপর শুরু হলো আর্থিক লড়াই। চাকরির জমানো সামান্য টাকা আর বাবার জমানো পুঁজি দিয়ে এত বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না। অন্তর যখন সরকারি যুব উন্নয়ন ঋণের জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করল, তখন সে দেখল বাস্তবতার কঠিন রূপ। ফাইলের পর ফাইল, এক অফিস থেকে আরেক অফিসে ঘোরাঘুরি, আর কর্মকর্তাদের অবহেলার দৃষ্টি—সবকিছু মিলিয়ে তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙার উপক্রম হলো।
অন্যদিকে, গ্রামের চায়ের দোকানে তাকে নিয়ে শুরু হলো নতুন আলোচনা। তার সমবয়সীরা হাসাহাসি করত, আর মুরুব্বিরা টিপ্পনি কেটে বলত, “লেখাপড়া শিখে ছেলেটার মাথাটাই গেছে,” কেউ বা বলত, “বাপের জমানো টাকাগুলো এবার পানিতে ফেলবে।” এই পারিবারিক চাপ, আর্থিক অনিশ্চয়তা আর সামাজিক টিটকারি—সবকিছু যেন একজোট হয়ে অদৃশ্য এক দেয়াল তুলে দিল অন্তরের স্বপ্নের সামনে।
প্রথম উদ্যোগ (First initiative)
কিন্তু অন্তর দমে যাওয়ার পাত্র ছিল না। সব প্রতিকূলতাকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে সে তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজ শুরু করল। সে বাবাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বোঝাত আধুনিক খামারের লাভ-ক্ষতির হিসাব, দেখাত ইন্টারনেটে সফল খামারিদের ভিডিও। অবশেষে ছেলের চোখের জেদ আর অদম্য ইচ্ছা দেখে মন গলল বাবার। ব্যাংক থেকেও বহু চেষ্টার পর ঋণ পাশ হলো।
এরপর শুরু হলো “সোনাতলা এগ্রো ফার্ম”-এর নির্মাণযজ্ঞ। গ্রামের সবাই যখন অবাক হয়ে দেখছিল, অন্তর তখন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মিস্ত্রিদের সাথে নিয়ে তার পরিকল্পনা মতো উঁচু মাচার ওপর স্বাস্থ্যসম্মত ঘর তৈরি করছে। এরপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অন্তর নিজে অন্য জেলায় গিয়ে সেরা খামারগুলো থেকে বেছে বেছে ১৫টি স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ব্ল্যাক বেঙ্গল পাঠী আর ২টি তোতাপুরী পাঁঠা কিনে আনল।
সেই ছাগলগুলোকে যখন সে প্রথমবার খামারে তুলল, তার মনে হলো যেন নিজের পরম যত্নে গড়া স্বপ্নটা আজ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে নিজের হাতে ঘাস কাটা, গম-ভুট্টা মিশিয়ে সুষম খাদ্য তৈরি করা, আর গভীর রাত পর্যন্ত প্রত্যেকটি ছাগলের যত্ন নেওয়া—এভাবেই শুরু হলো অন্তরের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। তার এই কঠোর পরিশ্রম দেখে যে গ্রামবাসীরা একদিন টিটকারি করেছিল, তারাও আড়ালে বলতে শুরু করল, “ছেলেটার মধ্যে অসম্ভব জেদ আছে।”
সংগ্রাম ও ব্যর্থতা (Struggle and failure)
খামার যখন ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল, স্বপ্নগুলো যখন ডানা মেলতে শুরু করেছিল, ঠিক তখনই নেমে এলো সবচেয়ে বড় আঘাত। বর্ষার এক ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে সকালে অন্তর দেখল, তার সবচেয়ে প্রিয় আর নাদুসনুদুস পাঠীটা খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, আর তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। পরদিন আরও কয়েকটি ছাগলের একই অবস্থা। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাকে ফোন দিতেই তিনি যা আশঙ্কা করেছিলেন, তাই সত্যি হলো—খামারে পিপিআর রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। ভ্যাকসিন দেওয়া সত্ত্বেও হয়তো কোনোভাবে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটেছে।
চোখের সামনে কয়েক দিনের ব্যবধানে ৪টি বড় ছাগল আর ৬-৭টি বাচ্চা অসহায়ভাবে মারা গেল। প্রতিটি মৃত্যু যেন অন্তরের বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছিল। যে ছাগলগুলোকে সে সন্তানের মতো ভালোবাসত, তাদের নিথর দেহ মাটিচাপা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। আর্থিক ক্ষতি তো ছিলই, তার চেয়েও বড় ছিল মানসিক যন্ত্রণা। বাবার বিবর্ণ মুখ, আর গ্রামের لوگوںর “আগেই বলেছিলাম” ধরনের কানাঘুষা তার আত্মবিশ্বাসকে পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দিল। এক গভীর রাতে সে বাবাকে বলেই ফেলল, “বাবা, আমার দ্বারা হয়তো হবে না। আমার সিদ্ধান্তটাই ভুল ছিল। সব বিক্রি করে দিয়ে আবার চাকরির চেষ্টা করব।”
ধীরে ধীরে সাফল্যের দেখা পাওয়া (Gradually seeing success)
সেই অন্ধকার সময়ে, যখন অন্তর প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিল, তখন দেবদূতের মতো পাশে এসে দাঁড়ালেন সেই প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। তিনি অন্তরকে বোঝালেন, “ব্যবসায় এমন ধাক্কা আসবেই। ব্যর্থতা এই পথের অংশ। এখান থেকে শিক্ষা নিয়েই তোমাকে এগোতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না, আমি তোমার পাশে আছি।”
তার কথায় আর নিজের ভেতরের জেদের আগুনে পুড়ে অন্তর আবার উঠে দাঁড়াল। সে খামারের জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাল। বাইরে থেকে আসা মানুষের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করল, খামারের প্রবেশপথে জীবাণুনাশক স্প্রে বাধ্যতামূলক করল। ধীরে ধীরে বাকি ছাগলগুলো সুস্থ হয়ে উঠল। কয়েক মাস পর খামারে যখন এক সাথে অনেকগুলো নতুন বাচ্চা জন্মাল, তাদের লাফালাফি দেখে অন্তরের মুখে আবার এক চিলতে হাসি ফুটল।
এবার সে বাজারজাতকরণের জন্য নতুন পথ ধরল। স্থানীয় বাজারের দালালের হাতে নিজেকে সঁপে না দিয়ে, সে সরাসরি বগুড়া শহরের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় রেস্তোরাঁর মালিকের সাথে দেখা করল। তার খামারের পরিচ্ছন্নতা, ছাগলের স্বাস্থ্য এবং তার পেশাদারিত্ব দেখে মালিক মুগ্ধ হলেন। তিনি পরীক্ষামূলকভাবে কিছু মাংস নিলেন এবং এর গুণগত মানে সন্তুষ্ট হয়ে নিয়মিত সরবরাহের একটি চুক্তি করলেন। যেদিন সে প্রথম বড় অঙ্কের চেকটি হাতে পেল, তার মনে হলো এই টাকাটা শুধু অর্থ নয়, এ তার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বীকৃতি, তার নির্ঘুম রাতের পুরস্কার।
ব্যবসার প্রসার (Business expansion)
প্রথম সাফল্য অন্তরকে আরও সাহসী এবং কৌশলী করে তুলল। সে বুঝতে পারল, আধুনিক যুগে ব্যবসার প্রসারে প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। সে “সোনাতলা এগ্রো ফার্ম” নামে একটি ফেসবুক পেজ খুলল। সেখানে সে শুধু বিক্রির জন্য ছাগলের ছবি দিত না, বরং কীভাবে সেগুলোর প্রাকৃতিক উপায়ে যত্ন নেয়, কী ধরনের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়ায়—তার ছোট ছোট ভিডিও এবং ছবি পোস্ট করত। তার এই স্বচ্ছতা ক্রেতাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করল।
কোরবানির ঈদের আগে তার পেজটি রীতিমতো ভাইরাল হয়ে গেল। শহরের মানুষেরা, যারা ভিড় ঠেলে হাটে না গিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত ও সুন্দর পশু খুঁজছিল, তারা অন্তরের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করল। সে অনলাইনেই প্রায় ২০টি ছাগল বিক্রি করল, যা স্থানীয় বাজারের দালালের দেওয়া দামের চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক ছিল। লাভের টাকা জমিয়ে সে খামারের আয়তন বাড়াল, ছাগলের সংখ্যা অল্প দিনেই ৫০ ছাড়িয়ে গেল। এর পাশাপাশি সে ছাগলের দুধ বিক্রির একটি ছোট্ট উদ্যোগও নিল, যা গ্রামের শিশু ও অসুস্থ মানুষের মধ্যে বেশ চাহিদা তৈরি করল। খামারের কাজ একা হাতে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ায় সে গ্রামেরই এক বেকার যুবককে সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিল। একদিন যে অন্তর একা স্বপ্ন দেখেছিল, আজ তার স্বপ্ন আরও একটি পরিবারের আয়ের উৎস হয়েছে—এই অনুভূতিটা ছিল তার কাছে কোটি টাকা লাভের চেয়েও বেশি আনন্দের।
অন্তর মিয়ার পথচলা থেকে যা শিখলাম (What I learned from Antar Mia’s journey)
অন্তর মিয়ার এই গল্প শুধু একটি অনুপ্রেরণার কাহিনি নয়, এটি তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বাস্তবসম্মত বিজনেস কেস স্টাডি। তার এই পথচলা থেকে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক শিক্ষা নিতে পারি:
১. জ্ঞান ও পরিকল্পনার সমন্বয়: আবেগ দিয়ে ব্যবসা শুরু করা গেলেও, তাকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। অন্তর কৃষিতে ডিপ্লোমা করেছিল এবং খামার শুরুর আগে যথেষ্ট গবেষণা করেছিল, যা তাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে।
২. ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ: ব্যবসায় ব্যর্থতা আসবেই। অন্তর পিপিআর রোগে তার поголовье হারানোর পর ভেঙে না পড়ে, ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছিল এবং খামারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করেছিল। ব্যর্থতাকে শেষ না ভেবে, একে একটি শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করাই সফল উদ্যোক্তার পরিচয়।
৩. আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার: অন্তর সনাতন পদ্ধতিতে আটকে না থেকে ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমকে তার মার্কেটিংয়ের হাতিয়ার বানিয়েছিল। এর মাধ্যমে সে সরাসরি ক্রেতার কাছে পৌঁছাতে পেরেছে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এড়াতে পেরেছে।
৪. ব্র্যান্ডিং ও স্বচ্ছতা: সে শুধু ছাগল বিক্রি করেনি, “সোনাতলা এগ্রো ফার্ম” নামে একটি ব্র্যান্ড তৈরি করার চেষ্টা করেছে। খাবারের মান, খামারের পরিবেশ—সবকিছু ক্রেতাদের সামনে তুলে ধরে সে একটি বিশ্বস্ততার সম্পর্ক তৈরি করেছে, যা দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের চাবিকাঠি।
৫. ধৈর্য ও অধ্যবসায়: পারিবারিক চাপ, সামাজিক টিটকারি এবং বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির পরেও অন্তর হাল ছেড়ে দেয়নি। তার ধৈর্য এবং নিজের স্বপ্নের প্রতি অবিচল আস্থা তাকে শেষ পর্যন্ত সাফল্য এনে দিয়েছে।
উপসংহার (Conclusion)
আজ সন্ধ্যায় অন্তর মিয়া যখন তার জমজমাট খামারের সামনে দাঁড়ায়, তখন তার বাবার মুখটা মনে পড়ে, যেখানে এখন আর হতাশা নেই, আছে ছেলের জন্য সীমাহীন গর্বের ঝলক। যে গ্রামবাসীরা তাকে নিয়ে একদিন হাসাহাসি করত, তারা এখন তাদের ছেলেদেরকে অন্তরের উদাহরণ দেয়, তার কাছে পরামর্শ নিতে আসে।
অন্তর মিয়ার গল্প আমাদের এটাই শেখায় যে, আপনার স্বপ্নটা যদি সৎ হয় এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য যদি আপনার মধ্যে অদম্য জেদ থাকে, তাহলে কোনো বাধাই আপনাকে আটকাতে পারবে না। তার “সোনাতলা এগ্রো ফার্ম” এখন শুধু একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি অনুপ্রেরণার বাতিঘর। এটি সোনাতলা গ্রামের তরুণদের দেখিয়ে দিয়েছে যে, চাকরির পেছনে না ছুটেও নিজের মাটিতে থেকেই সম্মানের সাথে, সাফল্যের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচা যায়। অন্তর জানে, তার পথচলা মাত্র শুরু হয়েছে; এই খামারকে সে একদিন দেশের অন্যতম সেরা একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার স্বপ্ন দেখে। আর আমরা জানি, এমন হাজারো অন্তর বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে লুকিয়ে আছে, যাদের দরকার শুধু একটু সাহস আর সঠিক পথের দিশা।