অনন্ত জলিল: সফল গার্মেন্টস ব্যবসায়ী থেকে যেভাবে হলেন সিনেমার পর্দার নায়ক
ভূমিকা (Introduction)
‘অসম্ভবকে সম্ভব করাই অনন্তের কাজ’—এই সংলাপটি শোনেননি এমন বাংলাদেশি খুঁজে পাওয়া কঠিন। অনন্ত জলিল, এই নামটি উচ্চারিত হওয়ামাত্রই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে সিনেমার অ্যাকশন-ঠাসা দৃশ্য, হেলিকপ্টার থেকে নায়কের অবতরণ কিংবা আন্তর্জাতিক মানের জমকালো সব আয়োজন। তিনি একাধারে একজন নায়ক, পরিচালক, প্রযোজক এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে একজন আইকন, যিনি বাংলা চলচ্চিত্রকে নতুন আঙ্গিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু তার এই রঙিন পর্দার জীবনের আড়ালে রয়েছে আরও একটি বিশাল জগৎ, যা হয়তো অনেকেরই অজানা। সেই জগতে তিনি কোনো সিনেমার নায়ক নন, বরং বাস্তব জীবনের একজন নায়ক—একজন বিচক্ষণ, পরিশ্রমী এবং সফল শিল্পপতি।
এই আর্টিকেলে আমরা পর্দার অনন্ত জলিলকে ছাপিয়ে তার পেছনের মানুষটিকে আবিষ্কারের চেষ্টা করব। আমরা জানব তার চলচ্চিত্র জীবনের চাকচিক্যের বাইরে এক কঠোর পরিশ্রমী তরুণের গল্প, যিনি শূন্য থেকে শুরু করে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল গার্মেন্টস সাম্রাজ্য—‘এজেআই গ্রুপ’। তার ব্যবসায়িক জীবনের উত্থান-পতন, কৌশল এবং দর্শনের মধ্য দিয়ে আমরা খুঁজে বের করব, কীভাবে মুন্সিগঞ্জের এক সাধারণ কিশোর দেশের অন্যতম সেরা গার্মেন্টস রপ্তানিকারক হয়ে উঠলেন। এই লেখাটি আপনাকে জানাবে, কীভাবে তার ব্যবসায়িক সাফল্য তার সিনেমার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে এবং কীভাবে তিনি এই দুই জগৎকে এক সুতোয় বেঁধে এগিয়ে চলেছেন। চলুন, শুরু করা যাক সেই অবিশ্বাস্য অভিযাত্রার গল্প।
অনন্ত জলিলের উত্থানের গল্প (The story of the rise of Ananta Jalil)
প্রতিটি সফল মানুষের পেছনে থাকে একটি সংগ্রামের গল্প, থাকে অজস্র বাধা অতিক্রম করার দৃঢ় সংকল্প। অনন্ত জলিলের গল্পটিও তার ব্যতিক্রম নয়। সিনেমার পর্দায় আমরা যে আত্মবিশ্বাসী এবং অপ্রতিরোধ্য নায়ককে দেখি, তার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল বহু বছর আগে, ব্যবসায়িক জীবনের কঠিন বাস্তবতায়। তার এই পথচলা শুরু হয়েছিল সাধারণ এক কিশোরের স্বপ্ন দেখার মধ্য দিয়ে।
সফল উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন (Dream of becoming a successful entrepreneur)
অনন্ত জলিলের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা মুন্সিগঞ্জের এক সাধারণ পরিবারে। তার শৈশব ছিল আর দশটা সাধারণ শিশুর মতোই, কিন্তু জীবনের প্রথম বড় ধাক্কাটি আসে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে, যখন তিনি তার মাকে হারান। মাতৃহীন শৈশব তাকে সময়ের আগেই পরিণত করে তোলে। বাবার ছত্রছায়ায় বড় ভাই তার জীবনে হয়ে ওঠেন অভিভাবক এবং সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার উৎস। বড় ভাইয়ের দেখানো পথ এবং নিজের ভেতরের জেদ তাকে শিখিয়েছিল, জীবনে বড় হতে হলে কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই।
তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরুটা হয়েছিল ঢাকার স্বনামধন্য অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। সেখান থেকে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল সম্পন্ন করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। ভর্তি হন বিখ্যাত ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে। তার পড়ার বিষয় ছিল ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ) এবং ফ্যাশন ডিজাইনিং। এখানেই তার ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের বীজ রোপিত হয়। বিবিএ পড়ার মাধ্যমে তিনি ব্যবসার তাত্ত্বিক দিক, ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। অন্যদিকে, ফ্যাশন ডিজাইনিং তাকে পোশাক শিল্পের সৃজনশীল জগৎ, কাপড়ের মান, ডিজাইন এবং বৈশ্বিক ট্রেন্ড সম্পর্কে গভীর ধারণা দেয়। এই দুই বিষয়ের জ্ঞানই পরবর্তীকালে তাকে একজন সফল গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু ব্যবসা করলেই হবে না, পণ্যের গুণগত মান এবং সৃজনশীল ডিজাইনই তাকে আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখবে। পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে তিনি চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।
১৯৯৬ সাল গার্মেন্টস ব্যবসায় প্রথম পদক্ষেপ (First steps in the garment business in 1996)
১৯৯৬ সাল। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প তখন সবেমাত্র বিশ্ববাজারে নিজের জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। অনন্ত জলিল এই সম্ভাবনাময় খাতকেই তার কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিলেন। কিন্তু স্বপ্ন দেখা আর তা বাস্তবায়ন করার মধ্যে ছিল বিস্তর ফারাক। একজন তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে তাকে অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
প্রথম এবং প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল মূলধন সংগ্রহ। কোনো ব্যবসায়িক পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। পরিবারের সহায়তায় এবং নিজের জমানো কিছু অর্থ দিয়ে তিনি খুব ছোট পরিসরে কাজ শুরু করেন। এরপরের চ্যালেঞ্জ ছিল বাজার বোঝা। কারখানায় কী ধরনের পোশাক তৈরি হবে, কোন দেশে সেই পোশাকের চাহিদা বেশি, ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করার উপায় কী—এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে তাকে দিনের পর দিন পরিশ্রম করতে হয়েছে।
সেই সময়ে গার্মেন্টস শিল্পে প্রতিযোগিতা ছিল তীব্র। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের ভিড়ে নিজের জায়গা করে নেওয়া ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। অনেক সময় ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যেত না, আবার কখনও বা অর্ডারের পর সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা যেত না। এমনও দিন গেছে যখন কারখানার শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার টাকা জোগাড় করতে তাকে হিমশিম খেতে হয়েছে। কিন্তু কোনো চ্যালেঞ্জই তাকে দমাতে পারেনি। তিনি দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮-২০ ঘণ্টা কারখানায় পড়ে থাকতেন। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করতেন, শ্রমিকদের সাথে কথা বলতেন এবং তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখতেন। তার সততা, কঠোর পরিশ্রম এবং গুণগত মানের প্রতি আপোষহীন মনোভাব ধীরে ধীরে ক্রেতাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে শুরু করে। একটি-দুটি করে অর্ডার আসতে থাকে এবং তিনি সফলভাবে সেগুলো সরবরাহ করতে সক্ষম হন। এভাবেই তিলে তিলে তিনি গড়ে তোলেন তার ব্যবসার ভিত্তি, যা একসময় পরিণত হয় এক বিশাল শিল্প প্রতিষ্ঠানে।
এজেআই গ্রুপ (AJI Group): একটি সফলতার নাম
ছোট পরিসরে শুরু হওয়া সেই উদ্যোগ আজ এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। অনন্ত জলিলের মেধা, শ্রম এবং দূরদর্শিতার ফসল হিসেবে জন্ম নিয়েছে ‘এজেআই গ্রুপ’—বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের এক সুপরিচিত এবং সফল নাম। এটি শুধু একটি কোম্পানি নয়, এটি হাজারো শ্রমিকের কর্মসংস্থান এবং দেশের অর্থনীতিতে রাখা এক গুরুত্বপূর্ণ অবদানের প্রতীক।
এজেআই গ্রুপ কী এবং এর পরিধি কতটা বিস্তৃত? (What is the AJI Group and how broad is its scope?)
এজেআই গ্রুপ (AJI Group) হলো অনন্ত জলিলের হাতে গড়া একটি শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান। এর অধীনে একাধিক সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে এ.বি. সোর্সিং এবং এজেআই ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড অন্যতম। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে একটি শক্তিশালী সাপ্লাই চেইন তৈরি করেছে, যা এক ছাদের নিচে পোশাক উৎপাদনের প্রায় সকল সুবিধা প্রদান করে।
এজেআই গ্রুপ মূলত ওভেন এবং ডেনিম জাতীয় পোশাক তৈরিতে বিশেষ পারদর্শী। তাদের উৎপাদিত পণ্যের তালিকায় রয়েছে ডেনিম প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ক্যাজুয়াল পোশাক। তাদের মূল ক্রেতা হলো ইউরোপ এবং আমেরিকার প্রথম সারির সব ফ্যাশন ব্র্যান্ড। স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, ইতালি, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের প্রায় সব বড় দেশেই এজেআই গ্রুপের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই তাদের পণ্য বিশ্ববাজারে স্থান করে নিয়েছে।
এর পরিধি শুধু উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এজেআই গ্রুপ দেশের অর্থনীতিতে এক বিরাট ভূমিকা পালন করছে। তাদের কারখানাগুলোতে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন। এই বিশাল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তিনি শুধু তাদের পরিবারকেই সচ্ছল করছেন না, বরং দেশের বেকারত্ব হ্রাসেও অবদান রাখছেন। তার প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের রিজার্ভকে শক্তিশালী করছে, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনন্ত জলিলের ব্যবসায়িক কৌশল ও দর্শন (Ananta Jalil’s business strategy and philosophy)
এজেআই গ্রুপের আকাশচুম্বী সফলতার পেছনে রয়েছে অনন্ত জলিলের কিছু মৌলিক ব্যবসায়িক কৌশল এবং দর্শন, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে।
- গুণগত মানের প্রতি আপোষহীন মনোভাব: অনন্ত জলিল শুরু থেকেই একটি বিষয়ে ছিলেন আপোষহীন—পণ্যের গুণগত মান। তিনি বিশ্বাস করেন, আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে হলে মানের সাথে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই তিনি তার কারখানায় একটি শক্তিশালী কোয়ালিটি কন্ট্রোল (QC) টিম গঠন করেছেন, যারা উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে—সুতা কেনা থেকে শুরু করে কাপড়ের ডায়িং, প্রিন্টিং, সেলাই এবং ফিনিশিং পর্যন্ত—কঠোরভাবে মান পরীক্ষা করে।
- আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার: বিশ্ব বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে তিনি তার ফ্যাক্টরিতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। জার্মানি ও জাপান থেকে আমদানি করা অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি তার উৎপাদন ক্ষমতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে একদিকে যেমন পণ্যের ফিনিশিং সুন্দর হয়, তেমনই কম সময়ে বিপুল পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হয়। প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উৎপাদন খরচও কমে আসে, যা তাকে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পণ্য সরবরাহ করতে সহায়তা করে।
- শক্তিশালী সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট: গার্মেন্টস ব্যবসার সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে একটি কার্যকর সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনার ওপর। কাঁচামাল (যেমন: কাপড়, সুতা, বোতাম) সময়মতো সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে, পোশাক তৈরি এবং সবশেষে বিদেশি ক্রেতার কাছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য পৌঁছে দেওয়া—এই পুরো প্রক্রিয়াটি তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেন। তার শক্তিশালী নেটওয়ার্কের কারণে তিনি খুব সহজে এবং সুলভ মূল্যে উন্নত মানের কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারেন, যা তার উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সচল রাখে।
অনন্ত জলিলের ব্যবসায়িক দর্শন হলো—‘স্বপ্ন দেখতে হবে বড়, আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম এবং সততা’। সিনেমার পর্দায় বলা তার সেই বিখ্যাত সংলাপ, ‘অসম্ভবকে সম্ভব করাই অনন্তের কাজ’—যেন তার বাস্তব জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
একজন শ্রমিক-বান্ধব শিল্পপতি (A worker-friendly industrialist)
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নানা ইতিবাচক আলোচনার পাশাপাশি শ্রমিকদের অধিকার এবং কর্মপরিবেশ নিয়েও প্রায়শই প্রশ্ন ওঠে। এমন একটি প্রেক্ষাপটে অনন্ত জলিল নিজেকে একজন ব্যতিক্রমী এবং শ্রমিক-বান্ধব শিল্পপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার কাছে, কারখানার শ্রমিকরা কেবল উৎপাদনের যন্ত্র নয়, বরং তার সাফল্যের পথের সহযোদ্ধা।
কর্মীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ (Facilities and safe working environment for employees)
অনন্ত জলিল সবসময় বিশ্বাস করেন যে, শ্রমিকরা সন্তুষ্ট থাকলে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পায়। তাই তিনি সরকারি নিয়ম-নীতির বাইরেও কর্মীদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছেন। তার কারখানায় শ্রমিকদের জন্য রয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ, পরিচ্ছন্ন ক্যান্টিন এবং সুচিকিৎসার ব্যবস্থা। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি কর্মীদের জন্য স্বাস্থ্য বীমার ব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়া, উৎসবগুলোতে সময়মতো বোনাস প্রদান এবং প্রয়োজনে কর্মীদের আর্থিক সহায়তা করার মতো উদ্যোগ তাকে শ্রমিকদের কাছে ‘মালিক’ নয়, বরং ‘অভিভাবক’ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে।
বিশেষ করে, ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সালের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর যখন বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ তৈরি হয়, তখন অনন্ত জলিল তার কারখানার নিরাপত্তা কাঠামোকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার উপর জোর দেন। তিনি নিশ্চিত করেন যেন তার কারখানায় পর্যাপ্ত অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা, জরুরি বহির্গমন পথ এবং ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত সকল আন্তর্জাতিক মান (কমপ্লায়েন্স) কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। তার এই উদ্যোগগুলো শুধু তার শ্রমিকদের জীবনকেই সুরক্ষিত করেনি, বরং বিদেশি ক্রেতাদের কাছেও তার প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।
সামাজিক দায়বদ্ধতা (CSR) ও মানবিক কার্যক্রম
ব্যবসায়িক সাফল্যের পাশাপাশি অনন্ত জলিল তার সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্যও বিশেষভাবে প্রশংসিত। তিনি মনে করেন, সমাজের প্রতি তার একটি দায়িত্ব রয়েছে এবং ব্যবসা থেকে অর্জিত লাভের একটি অংশ সমাজের কল্যাণে ব্যয় করা উচিত। এই দর্শন থেকেই তিনি বছরের পর বছর ধরে নীরবে বিভিন্ন মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন।
তিনি একাধিক এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেখানে শত শত অনাথ শিশু বেড়ে উঠছে। এই এতিমখানাগুলোর সম্পূর্ণ খরচ তিনি ব্যক্তিগতভাবে বহন করেন। পাশাপাশি, নিজ এলাকা মুন্সিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণে তিনি নিয়মিত আর্থিক অনুদান দেন। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে, যেমন—বন্যা বা শীতে, তিনি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ থেকে শুরু করে বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সহায়তা—সবখানেই তার মানবিক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তার এই মানবিক গুণাবলী তাকে একজন সফল ব্যবসায়ীর চেয়েও বড়, একজন ভালো মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এক সুতোয় গাঁথা দুই ভুবন (Two worlds woven together by one thread)
গার্মেন্টস ব্যবসায় যখন তিনি সাফল্যের চূড়ায়, ঠিক তখনই অনন্ত জলিল এক নতুন জগতে পা রাখার সিদ্ধান্ত নেন—চলচ্চিত্র। অনেকের কাছেই তার এই সিদ্ধান্তটি ছিল বিস্ময়কর। একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি কেন এই অনিশ্চিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ জগতে বিনিয়োগ করতে চাইছেন, তা নিয়ে ছিল নানা জল্পনা-কল্পনা। কিন্তু অনন্তের কাছে এটি ছিল তার শৈশবের এক স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার প্রয়াস।
কেন তিনি চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ শুরু করলেন? (Why Cinema…?)
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দুটি দিক সামনে আসে—প্যাশন এবং ব্যবসায়িক কৌশল। প্রথমত, ছোটবেলা থেকেই সিনেমার প্রতি তার ছিল তীব্র আকর্ষণ। তিনি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক মানে দেখতে চাইতেন, যেখানে থাকবে হলিউড-বলিউডের মতো ঝকঝকে প্রোডাকশন, দুর্দান্ত অ্যাকশন এবং উন্নত প্রযুক্তি। এই স্বপ্ন বা প্যাশনই তাকে চলচ্চিত্র জগতে টেনে আনে।
দ্বিতীয়ত, এর পেছনে ছিল তার সুচতুর ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, চলচ্চিত্র একটি শক্তিশালী মাধ্যম যার মাধ্যমে সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। সিনেমার মাধ্যমে তিনি শুধু বিনোদনই দিতে চাননি, বরং নিজের প্রতিষ্ঠান ‘এজেআই গ্রুপ’-এর একটি ইতিবাচক ব্র্যান্ড ইমেজও তৈরি করতে চেয়েছেন। ২০১০ সালে ‘খোঁজ-দ্য সার্চ’ সিনেমার মাধ্যমে যখন তিনি আত্মপ্রকাশ করেন, তখন তিনি শুধু একজন নায়ক হিসেবে আসেননি, এসেছিলেন একজন ব্র্যান্ড হিসেবে।
এই লক্ষ্যেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তার নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা ‘মুনসুন ফিল্মস’। এই ব্যানারে তিনি একের পর এক বড় বাজেটের এবং আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা নির্মাণ করতে শুরু করেন, যা বাংলাদেশি সিনেমার দর্শকদের জন্য ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা।
ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা যেভাবে সিনেমার জগতে কাজে লেগেছে
গার্মেন্টস শিল্পে অর্জিত অভিজ্ঞতা অনন্ত জলিলকে সিনেমার জগতে সফল হতে দারুণভাবে সহায়তা করেছে। একটি বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি চালানো আর একটি বিশাল বাজেটের সিনেমা নির্মাণ করার মধ্যে ব্যবস্থাপনাগত দিক থেকে অনেক মিল রয়েছে।
- প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট: হাজার হাজার শ্রমিক এবং শত শত মেশিনারি নিয়ে একটি ফ্যাক্টরি পরিচালনার অভিজ্ঞতা তাকে সিনেমার বিশাল ইউনিট সামলানোর দক্ষতা দিয়েছিল। শ্যুটিংয়ের পরিকল্পনা, বাজেট নিয়ন্ত্রণ এবং সময়মতো কাজ শেষ করার ক্ষেত্রে তার এই অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে।
- ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং: একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি মার্কেটিংয়ের গুরুত্ব খুব ভালোভাবেই বুঝতেন। তিনি নিজেকে এবং তার সিনেমাকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অভিনব সব প্রচারণা কৌশল ব্যবহার করেন। ‘অসম্ভবকে সম্ভব করাই অনন্তের কাজ’—এই ট্যাগলাইনটি তার দুর্দান্ত মার্কেটিং দক্ষতারই ফসল, যা তাকে সাধারণ মানুষের কাছে এক লার্জার-দ্যান-লাইফ ইমেজ দিয়েছে।
- আর্থিক স্বাধীনতা: গার্মেন্টস ব্যবসা থেকে অর্জিত বিপুল অর্থ তাকে সিনেমায় বিনিয়োগের স্বাধীনতা দিয়েছে। যেখানে অনেক প্রযোজক বাজেটের অভাবে ভালো সিনেমা নির্মাণ করতে পারেন না, সেখানে অনন্ত জলিল টাকার দিকে না তাকিয়ে সিনেমার মানের দিকে মনোযোগ দিতে পেরেছেন। ‘দিন: দ্য ডে’-এর মতো আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা নির্মাণ তার আর্থিক সক্ষমতারই প্রমাণ।
অনন্ত জলিলের মোট সম্পদ এবং বিলাসবহুল লাইফস্টাইল
কঠোর পরিশ্রম এবং ব্যবসায়িক সাফল্যের মাধ্যমে অনন্ত জলিল অর্জন করেছেন বিপুল সম্পদ, যা তার বিলাসবহুল জীবনযাত্রার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। তবে তার এই বিত্ত-বৈভব একদিনে তৈরি হয়নি, এর পেছনে রয়েছে বহু বছরের সাধনা ও অধ্যবসায়।
- আয়ের উৎস: তার আয়ের প্রধান উৎস হলো তার গার্মেন্টস ব্যবসা ‘এজেআই গ্রুপ’। এটিই তার অর্থনৈতিক শক্তির মূল ভিত্তি। এছাড়া, চলচ্চিত্র প্রযোজনা এবং অভিনয় থেকেও তিনি আয় করেন। বিভিন্ন পণ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবেও তার আয় রয়েছে।
- সম্পদের পরিমাণ (আনুমানিক): অনন্ত জলিলের মোট সম্পদের পরিমাণ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও, বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং তার ব্যবসার পরিধি বিচার করে ধারণা করা হয়, তিনি বাংলাদেশের অন্যতম ধনী ব্যক্তিদের একজন। তার সম্পদের পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করা হয়।
- লাইফস্টাইল: অনন্ত জলিল এক রাজকীয় জীবনযাপন করেন। তার বিলাসবহুল বাড়ি, বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডের গাড়ি (যেমন: বেন্টলি), এবং মূল্যবান সব জিনিসপত্র সবসময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। তবে তিনি প্রায়শই বলেন, তার এই জীবনযাত্রা তার কঠোর পরিশ্রমের ফসল এবং তিনি তার উপার্জনের একটি বড় অংশ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করতে ভালোবাসেন।
উপসংহার (Conclusion)
সিনেমার পর্দার অ্যাকশন হিরো থেকে বাস্তব জীবনের শিল্পপতি—অনন্ত জলিলের এই যাত্রা এক কথায় অবিশ্বাস্য। তিনি শুধু একজন সফল গার্মেন্টস ব্যবসায়ীই নন, তিনি একজন স্বপ্নদ্রষ্টাও। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে সততা, কঠোর পরিশ্রম এবং উদ্ভাবনী মানসিকতা দিয়ে শূন্য থেকে একটি সাম্রাজ্য গড়ে তোলা যায়। তার গার্মেন্টস শিল্পের সাফল্য তাকে দিয়েছে আর্থিক সচ্ছলতা, আর সেই সচ্ছলতা দিয়ে তিনি পূরণ করেছেন তার শৈশবের স্বপ্ন—বাংলা সিনেমাকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেওয়ার।
অনন্ত জলিলের গল্প আমাদের শেখায় যে, জীবনের এক ক্ষেত্রের সাফল্য অন্য ক্ষেত্রের স্বপ্ন পূরণের সিঁড়ি হয়ে উঠতে পারে। তিনি একাধারে একজন শ্রমিক-বান্ধব শিল্পপতি, একজন মানবতাবাদী এবং একজন স্বপ্নবাজ নায়ক। তার জীবনযাত্রা হাজারো তরুণের জন্য অনুপ্রেরণার এক বাতিঘর, যা প্রমাণ করে—চেষ্টা করলে ‘অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়’।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
অনন্ত জলিলের গার্মেন্টস কোম্পানির নাম কী?
- তার মূল কোম্পানির নাম এজেআই গ্রুপ (AJI Group), যা বাংলাদেশের একটি অন্যতম শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।
অনন্ত জলিল কত সাল থেকে ব্যবসা শুরু করেন?
- তিনি ১৯৯৬ সালে একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আজকের অবস্থানে এসেছেন।
এজেআই গ্রুপ মূলত কোন ধরনের পোশাক তৈরি করে?
- এজেআই গ্রুপ মূলত ডেনিম প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট এবং অন্যান্য ওভেন ও নিটওয়্যার পোশাক তৈরি করে ইউরোপ ও আমেরিকার বিখ্যাত সব ফ্যাশন ব্র্যান্ডের জন্য।
- অনন্ত জলিলের প্রথম সিনেমার নাম কী?
- তার অভিনীত ও প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র হলো ‘খোঁজ-দ্য সার্চ’, যা ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়ার মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র জগতে আত্মপ্রকাশ করেন।